–যাচ্ছি। বলিয়া উভয়ে উঠিল। চলিতে চলিতে শিখা বলিল,আপনারা বুঝি এদের বড়দা আর ছোটদা।
হ্যাঁ, এখানে চাকর কেউ নেই। সবাই ভাই ভাই, সবাই অংশীদার।
—সব নিয়মই বুঝি আপনাদের দুজনের মস্তিষ্কপ্রসূত?
—সবই ঐ তপনের সৃষ্টি দেবী। মাথা আমার খোলে না। ও যা বলে, তাই আমি করে যাই।
আশ্চর্য। এই লোকটির মতো বন্ধুর উপর এমন অগাধ স্নেহ আর শ্রদ্ধা একযোগে পোষণ করিতে শিখা আর কাহাকেও দেখে নাই। নিজে তিনি কেমন, তাহা বুঝাইবার চেষ্টা মাত্র করিলেন না। বিনায়কের দিকে একটা সশ্রদ্ধ দৃষ্টিপাত করিয়া শিখা হাসিয়া বলিল,–সবইত ওঁর বলছেন, আপনার নিজের কি কিছুই নাই?
—আছে, আমার নিজের অতুল সম্পদ আছে। ঐ বন্ধু, আমার তপন। শিখা অভিভূত হইয়া গেল। দুজনে অফিস ঘরে আসিয়া পৌঁছিল। অফিস দেখিয়া শিখার চোখ জুড়াইয়া যাইতেছে। দেওয়ালে টাঙানো শিবমূর্তিগুলি যেন জীবন্ত। মেঝের আলপনাগুলি কোন অতীত যুগের সহিত যেন বর্তমানের যোগ স্থাপন করিতেছে। ঘরে ধুপসুরভীত বাতাস মন্থরমদির। চতুর্দিকে শান্তির আবহাওয়া। একটাও চেয়ার বা টেবিল নাই; থাকিলেও যেন এ ঘরে মানাইত না।
শিখা দ্বিধাহীন মনে ঠিক তপনের ছোট বোনটির মতই পলাশপাতাটা টানিয়া লইয়া খাইতে বসিল। খাইতে খাইতে বলিল—তোমাদের এখানে তো ভাই রোজ পিকনিক—আমার কিন্তু যেদিন খুসি ভাগ রইল এতে।
বিনায়ক বলিল,–খুসিটা যেন আপনার রোজই হয়।
শিখা বলিল,—আপনার ভাগে তাহলে কম পড়ে যাবে। দুই ভাইবোনে জুটলে আপনি পাবেন না।
হাসিতে হাসিতে বিনায়ক কহিল—না হয় হেরেই জিতবো।
—অর্থাৎ। শিখা তাকাইল।
তাহার চোখের দিকে চাহিয়া বিনায়ক বলিল,—অর্থাৎ এত বেশী হারবো যে হারের দিক দিয়ে আমিই হব ফাস্ট।
তিনজনেই হাসিয়া উঠিল।
তপতী আসিয়া অনুযোগ করিল,—সকাল থেকে তিনবার ফোন করলাম মা, শিখা কিছুতেই আসছে না—আমাদের পার্টিতে যাবে না বলছে।
-কেন? কি হল তার? যাবে না কেন? মা নিরীহের মতো প্রশ্ন করিলেন।
—কে জানে! তোমার জামাই কিছু বলেছে নাকি? সেই যে সেদিন ওর সঙ্গে দেখা করতে গেল তারপর থেকে আর শিখা আসেনি।
-জামাই কি বলবে খুকী। ওর নামে মিছেমিছি কেন বদনাম দিচ্ছিস?
মা বিরক্ত হইতেছে, কিন্তু তপতী ঝঙ্কার দিয়া কহিল, খুব বলতে পারে। যা অসভ্য। ভদ্র মেয়েদের সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে অভদ্রতা করা কিছু বিচিত্র নয়।
—ও কথাই বলেনা তো বেশী, ভদ্র কি আর অভদ্রই কি। তোদর পার্টিতে ওকে নিয়ে যাচ্ছিস তো আজ-দেখে নি আমার কথা ঠিক কি না।
—ওকেনাই-বা নিয়ে গেলুম মা, বিস্তর বড় বড় লোক যাবে সেখানে যদি কিছু অসভ্যতা করে বসে, গঙ্গার জলে সে লজ্জা ধোয়া যাবে না।
–সে কি খুকী, ওকে না নিয়ে গেলে ভাববে কি। লোকেইবা বলবে কি? নিরুপায় তপতী রাজি হইল, নতুবা মা হয়ত একটা সীন ক্ৰীয়েট করিয়া বসিবেন! বলিল,–আচ্ছা, তাহলে এই জিনিস কটা কিনে নিয়ে যেতে বলল। তপতী একটা লিস্ট দিল।
বন্ধুবর্গের সহিত তপতী পূর্বেই যাত্রা করিল। তপনকে মা যেমনটি আদেশ করিয়াছিলেন, সে তেমনি ভাবেই গিয়া স্টিমারে উঠিল এবং জিনিসগুলি চাকরের হাতে দোতলায় তপতীর নিকট পাঠাঁইয়া দিয়া নীচেই বসিয়া রহিল। যথাসময়ে স্টিমার ছাড়িয়া গেল।
উপর হইতে সঙ্গীতের মধুর সুরলহরী ভাসিয়া আসিতেছে। তপন অত্যন্ত সঙ্গীত প্রিয়। কান পাতিয়া শুনিতে লাগিল, আর ভাবিতে লাগিল—ঐ সভায় গিয়া একখানি গান গাহিলেই সে তপতীকে আকর্ষণ করিতে পারে কিন্তু যে নারী অন্য পুরুষের প্রতি আসক্তা, তাহাকে তপনের আর কোন প্রয়োজন নাই। তপনের জীবনসঙ্গিনীর স্থানে সে বসিতে পাইবে না।
তপতীর পরিচিতের সংখ্যা শতাধিক। প্রায় সকলেই আসিয়াছে। অতবড় স্টিমারখানা জুড়িয়া নানাভাবে নানা কথাবার্তা চলিতেছে। পরিচিত হিসাবে মিঃ ঘোষাল, যাঁহার সহিত তপতীর বিবাহ হইবার কথা ছিল, তিনিও আসিয়াছেন। তাহাকে দেখিবামাত্রই তপতীরলিয়া উঠিল,—আসুন, বাপের লক্ষ্মী ছেলে—আছেন কেমন?—এই বিদ্রূপ সকলেই উপভোগ করিল কিন্তু মিঃ ঘোষালের বুকের ভিতর কোথায় যেন একটা আনন্দের শিহরণ জাগিতেছে। বাপের ডাকে বিবাহ-সভা হইতে উঠিয়া যাওয়া তাহার চরম নির্বুদ্ধিতা, কিন্তু তাহার উদ্দেশ্য তো তাহা ছিল না। তপতীর বাবাই তো যত গোল বাধাইলেন। টাকাটা ফেলিয়া দিলেই চুকিয়া যাইত। মিঃ ঘোষালের জীবনে এই ব্যর্থতার ক্ষতি কোনদিন পূরণ হইবে না তথাপি আজ তিনি আনন্দিত হইলেন এই ভাবিয়া যে, তপতীর অনুযোগের অভ্যন্তরে ধ্বনিত হইয়া উঠিতেছে তাহার প্রতি ভালোবাসার ইঙ্গিত। তপতী সেদিন তাহাকে চাহিয়াছিল, আজো তাহাকে না পাওয়ার দুঃখ অনুভব করে। প্রীতিকণ্ঠে তিনি বলেন,–বরাতে সইলোনা তপতী দেবী, আমার দোষ কি বলুন?নইলে বাবার কথাকে মান্য আমি জীবনে ঐ একবারই করেছি, আর ঐবারই শেষ বার। কিন্তু এখন তো…
-হ্যাঁ, এখনো লক্ষ্মী ছেলের মতো চুপ করে থাকুন।
যে তাহার মুখের গ্রাস কাড়িযা লইয়াছে তাহাকে দেখিবার ইচ্ছা হওয়া মিঃ ঘোষালের পক্ষে স্বাভাবিক কিন্তু যাহাদের তিনি দেখিতেছেন, সকলেই প্রায় পরিচিত, স্বল্পপরিচিত। প্রশ্ন করিলেন,–তিনি কি আসেননি—আপনার স্বামী?
স্বামী কথাটা উচ্চারিত হইতে শুনিয়াই তপতীর মুখ লজ্জার হইয়া গেল।
–কি জানি, আছে কোথায় ওদিকে। বলিয়াই সে অর্গান লইয়া বসিল। চাকরটাকে জিজ্ঞাসা করিয়া সকলে জানিল, জামাইবাবুনীচে একাই বসিয়া আছেন। চপলা তরুণীর দল তৎক্ষণাৎ নামিয়া আসিল এবং তপনকে জোর করিয়া ধরিয়া লইয়া গেল। অতিথি বর্গ দেখিল, তাহার চোখে, একটা ঘন সবুজ রংএর ঠুলি, কপালে ও গণ্ডে চন্দনপঙ্ক। এদিকে পরনে কোট প্যান্ট এবং মাথায় হ্যাট। এই অদ্ভুত বেশ দেখিয়া সকলেই বিস্মিত, বিরক্ত হইল এবং একটা বিজয়ের উল্লাসও অনেকেই অনুভব করিল। তপতীর অহঙ্কার চূর্ণ হইয়া গিয়াছে। তপতী কোন দিন স্বামীর দিকে চাহে নাই, আজো চাহিল না। তরুণীর দল তপনকে লইয়া এক জায়গায় বসাইয়া দিল, বলিল,–স্বদেশী আর বিদেশীতে মেলাচ্ছেন বুঝি। কিন্তু টুপিটা খুলুন টিকি আর কাটবো না—অভয় দিচ্ছি।