কেন? কেন? আমি যেন বোকা সেজে অত্যন্ত ক্ষুণ্ণ হয়ে বলেছি, গণেশ হালুইকরের সদ্য উনুন থেকে নামানো রাবড়ির কড়াইয়ের ভুরভুরে গন্ধে সারা মিঠাইপাড়া মাত হয়ে গেছে। তাই দেখে এসে আমার বলাটা কী অন্যায় হয়েছে,
শুনি?
দোষের এই হয়েছে যে, শিশির গৌরের হয়ে কাটা ঘায়ে নুন ছড়িয়ে বলেছে, তোমার বর্ণনা শুনে আমাদের এখন বুক চাপড়ানো ছাড়া আর কিছু করবার নেই। গণেশ হালুইকরের রাবড়ির কড়াইয়ের বর্ণনা দিতে হাঁফাতে হাঁফাতে ছুটে আসার বদলে দু-কিলো কিনে আনতে পারলে না। গণেশ হালুইকরের রাবড়ির কড়াই একবার ভিয়েন থেকে নামবার পর কতক্ষণ দোকানে পড়ে থাকে। এতক্ষণে কড়াই চাঁছাপোছা হয়ে সব বিক্রি হয়ে গেছে দেখো গিয়ে! তবু পাঠিয়ে দেখি একবার বনোয়ারিকে, কী বলেন ঘনাদা?
শেষ কথাগুলো ঘনাদার দিকে চেয়ে যেন তাঁর অনুমতি নেওয়া।
কী বলেছেন তাতে ঘনাদা? অনুমতি দিয়েছেন, না জানিয়েছেন আপত্তি?
কী যে করেছেন সেইটে বোঝাই শক্ত।
আপত্তি ঠিক করেছেন তা বলা যায় না, কিন্তু যা বলেছেন, সেটাকে সানন্দ না হোক, কোনওরকম অনুমতিই বলা চলে কি?
নিজের মৌরসি আরামকেদারায় বসে হাতের কাগজটা থেকে মুখ না তুলেই নির্লিপ্ত গলায় তিনি বলেছেন, রাবড়ি আনাবে? তা ইচ্ছে হয়, আনাও। আর কিছু না হোক গায়ে চর্বি জমবে, ভুঁড়ি বাড়বে। মানে—
ঘনাদাকে আর কিছু বলতে হয়নি। তিনি পরের কথাটা আরম্ভ না করতেই মেজাজটা বুঝে নিয়ে শিবু চাল বদলে ফেলেছে।
রাবড়ি খাবে, রাবড়ি? সে আমাদের ভেংচিয়ে বলেছে, রাবড়ি খায় কারা? যত নিষ্কর্মা পেটুক। রাবড়ি খায় আর কুমড়োপটাশ হয়ে একদিন ফুটিফাটা হয়ে মারা যায়। না, না, ওসব রাবড়ি-টাবড়ি বাহাত্তর নম্বরে আর চলবে না।
ওদিকে কোপ্তা কাবাব মোগলাই পরোটাও নয়, আবার তার বদলে রাবড়িও না। তাহলে চলবেটা কী? সে জিজ্ঞাসাটা জিভের ডগায় এলেও কেউ আর আমরা করিনি। যাঁর জন্য এত পাঁয়তারা সেই তিনিই হঠাৎ কী যেন একটা অত্যন্ত দরকারি কথা মনে পড়ায় ব্যস্ত হয়ে উঠে ন্যাড়া ছাদের সিঁড়ির দিকে পা বাড়িয়েছেন।
ওদিকে যাচ্ছেন কোথায়, ঘনাদা? আমাদের ব্যাকুল প্রশ্ন যেন ভাল করে শুনতেই না পেয়ে কী একটা অস্পষ্ট জবাব দিয়ে ন্যাড়া ছাদের সিঁড়ি বেয়ে তাঁর টঙের ঘরে চলে গেছেন।
তা চলুন। মুশকিল আসানের চাবিকাঠি আমরা বোধহয় পেয়ে গেছি। অন্তত শিবুর তা-ই ধারণা। টঙের ঘরে উধাও হবার পর সেদিনই আড্ডাঘর থেকে তার নিজের কামরায় নিয়ে গিয়ে চাপা গলায় হলেও কেল্লাফতের মতো উত্তেজনা নিয়ে বলেছে, আর বোধহয় ভাবনা নেই। এবারকার ফুসমন্তর মনে হচ্ছে পেয়ে গেছি।
এবারকার ফুসমন্তর? আমি অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করেছি। সে আবার কী?
সে আবার কী বুঝিয়ে বলতে হবে? শিবু আমার বুদ্ধির স্থূলতায় হতাশ হয়ে বলেছে, ওঁর মেজাজ তাতিয়ে সুরে বেঁধে টঙ্কার ছাড়াতে কখন কী মোচড় লাগে তার ঠিক আছে? ওই মোচড়কেই বলছি ফুসমন্তর। কখনও তা কুলপির বদলে গরম কফি, আবার কখনও রাবড়ির বদলে মাথা না ঘামানো কিছু মানে অ্যাকশন। হ্যাঁ, এবারের ফুসমন্তর হল তাই।
তা সেই ফুসমন্তরই শিবু প্রয়োগ করল পরের দিন সকালে। দিনটা ছিল রবিবার। তাই সকাল থেকেই আমরা যথাস্থানে জমায়েত হয়েছি। টঙের তিনি আসতে একটু দেরি করে আমাদের উদ্বেগ বাড়ালেও শেষ পর্যন্ত উদাস উদাস কেমন একটু অন্যমনস্কভাবে নিজের মৌরসি চেয়ারটি দখল করেছেন। আসরটায় নেহাত ছাতা না ধরে যায় সেইজন্য আমরা ফুটবল নিয়ে হাওয়া গরম রাখবার চেষ্টা করতে করতে শিবুর নাটকীয় প্রবেশের জন্য অপেক্ষা করছি।
কিন্তু কোথায় শিবু? ফুটবল আর স্টেডিয়াম নিয়ে ঝগড়ার সব পুরনো খোঁচাখুঁচিগুলো যখন প্রায় ফুরিয়ে এসেছে তখন শিবু এসে ঘরে ঢুকেছে সত্যিই নাটকীয় ভাবে।
তবে তার প্রবেশের চিত্রনাট্যটা একটু আলাদা বলে প্রথমে একটু ভড়কেই যে গেছলাম তা অস্বীকার করব না।
ঠিক ছিল যে ফুটবল নিয়ে আমাদের নকল ঝগড়ার মাঝে শিবু একেবারে ঝড়ের মতো ঘরে এসে ঢুকে একপাক নেচে নিয়েই—তারপর ঘোষণা করবে—মার দিয়া! মার দিয়া কেল্লা।
কী মার দিয়া? কোন কেল্লা আবার মেরে এলে? আমাদের গলায় উঠবে সন্দিগ্ধ জিজ্ঞাসা। আবার তোমার সেই বাহাত্তর নম্বরের বদলে নতুন কোনও বাসা-টাসার খোঁজ নয় তো?
না, না—শিবু আমাদের আশ্বস্ত করে জানাবে—নতুন বাসা-টাসা নয়, বাহাত্তর নম্বর ছেড়ে খাস অমরাবতীর জোড়া ফ্ল্যাট পেলেও যে কেউ তোমরা নড়বে না তা জানি। ওসব কিছুর বদলে কোন কেল্লা ফতে করেছি একটু আন্দাজ করো তো দেখি?
এরপর প্যারিসের ভারত মেলায় যাবার ফ্রি টিকিট থেকে স্বয়ং পেলেকে একদিন বাহাত্তর নম্বরে এনে খানাপিনা করানো পর্যন্ত আন্দাজ করে হার মানবার পর শিবু তার কেল্লা ফতেটা ব্যাখ্যা করে আমাদের অবাক করে দেবে এই ছিল কথা।
তার জায়গায় শিবুর একী নাটকীয় প্রবেশ! সে যেন পালহেঁড়া হালভাঙা নৌকোর মতো কোনওরকমে বন্দরে এসে ভিড়ে মুখ থুবড়ে পড়ে হতাশ গলায় বলেছে, না, আর হল না।
সিনারিও বদলেছে। কিন্তু পরের সংলাপটা আপনা থেকেই মুখে এসে গেল। সত্যি অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করলাম, কী, হল না-টা কী?
সে আর বলে কী হবে? শিবু একটু বেশি পাঁয়তারা কষে বললে, যা সুবিধেটা হয়েছিল!
কী সুবিধেটা হয়েছিল, কী? ভান না করে বিরক্তি নিয়েই এবার বললাম, অত ধোঁয়া-টোঁয়া না ছেড়ে সাফ কথাটা বল দেখি।