যে সেখান থেকে আলো কি বেতার তরঙ্গও বাইরে আসতে পারে না।
গ্রহ নক্ষত্রের মতো সব কিছু যার মধ্যে তলিয়ে যায় সেই ফুটোর মধ্যেই কি তারা জমা হয়ে থাকে? না আর-এক দিকে আর-এক ফুটো আছে তাদের বার হবার? সেই রকম সাদা ফুটোর কথা যারা অনুমান করেছেন তাঁরা ভুল করেননি। এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সঙ্গে অন্য বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের যোগাযোগের এমনই কালো ফুটো আর সাদা ফুটো সত্যি আছে।
বিশ্ব নয়, নিখিল ব্ৰহ্মাণ্ডই বলি। সেই নিখিল ব্রহ্মাণ্ডের কোনও অজানা নিয়মে কিছুক্ষণের জন্য তোমাদের ব্রহ্মাণ্ডের সাদা ফুটো দিয়ে অন্য জগতের কিছুক্ষণের যোগাযোগ সম্ভব হয়েছে। তিন ডাইমেনশন বা মাপের জায়গায় চারের কি পঞ্চম ডাইমেনশন-এর কল্যাণে কিছুক্ষণের জন্য এক জায়গায় পরস্পরকে দু জগৎ ছুঁয়েই ফেলেছে। কিন্তু সে শুধু সামান্য একটু সময়ের জন্য। ওই দেখো, এখনই সব ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে। আমরা বিচ্ছিন্ন হয়ে যাচ্ছি। বিদায় ক্ষণিকের বন্ধু, বিদায়।
মাথার ভেতর শব্দতরঙ্গ যেমন থামল, অদ্ভুত রঙের জগৎও তেমনই কিছুক্ষণের জন্য ঝাপসা হয়ে আকাশ পরিষ্কার হয়ে গেল। কই, কোথায় সেই সবুজ আলোর সভা অক্টোপাসের দেশ? এ তো সেই ধু ধু লাল মাটির মরু প্রান্তর।
আর আমি কি বিছানায় শুয়ে স্বপ্ন দেখছিলাম? না, তা তো নয়, আমি ভাঙা বাংলোর বাইরে এসে দাঁড়িয়ে আছি। যা দেখছি কিছু তাহলে মিথ্যে নয়!
ঘনাদা চুপ করলেন।
সাক্ষাৎকার নিতে আসা একজন জিজ্ঞাসা করল, আপনার দু কপালে সাঁটা। যন্ত্রটা—সেটা খুলে নিয়ে গেছিল তো?
কিছু না বলে ঘনাদা শুধু ঠোঁটের ওপর তর্জনীটা চাপা দিলেন।
শিবু ব্যাখ্যা করে বলল, আপনাদের শুধু একটা প্রশ্ন করারই অনুমতি ছিল সেটা ভুলবেন না।
ঘনাদাকে কী করে পেলাম
একটা প্রশ্ন প্রায়ই শুনতে হয়।
ঘনাদাকে কোথায় পেলেন?
কোথায় আবার? পেয়েছি নিজেরই মধ্যে, আপনাদের সকলের মধ্যেও।
বলাই বাহুল্য, উত্তরটা সকলকে খুশি করে না। কিন্তু কথাটা নির্ভেজাল সত্যি নয় কি?
আজ বলে নয়, মানুষের মুখে যখন থেকে কথা ফুটেছে তখন থেকেই বাহাদুরি নিতে বাড়িয়ে বলা বানিয়ে বলা তার শুরু হয়েছে, সন্দেহ নেই। সেই কোন আদ্যিকালে প্রথম যে গোদা লেজ-খসা গেছে বাঁদর গাছের ডাল ছেড়ে মাটিতে নেমে একটু খাড়া হয়ে দাঁড়াবার চেষ্টা করে দু-এক পা হেঁটেই মাটিতে কেতরে পড়েছিল, সেও বোধহয় তার সঙ্গী-সাথীদের কিছু অঙ্গভঙ্গি আর কিচির-মিচির ঘোঁৎঘোঁতানি দিয়ে বোঝাবার চেষ্টা করেছিল যে চার পায়ের বদলে দু পায়েই সোজা হয়ে দাঁড়ানো আর হাঁটা তার কাছে দাঁত কিড়মিড়ির মতোই সোজা।
ঘনাদাকে পাবার জন্যে খুব বেশি খোঁজাখুঁজির হয়রানি তাই হয়নি। মানুষের চিরকেলে স্বভাবই নতুন কালের ধড়াচূড়া পরে ঘনাদা হয়ে বেরিয়ে এসেছেন।
তা, ঘনাদা তো আসর জমাতে খাস ভূমিকায় নিজেই মুল গায়েন হয়ে বিজ্ঞানের ধোঁয়ায় ফাঁপানো সব গালগল্প শোনান। তারপর আবার তস্য তস্য কী ও কেন?
দুকথায় সহজ করে বলতে চাইলে বলতে হয়, প্রথমটায় বিজ্ঞানের রহস্য যদি প্রধান হয় তাহলে দ্বিতীয়টায় ইতিহাসের।
ঘনাদার নিজের বাহাদুরি গল্প লিখতে লিখতে মাঝে মাঝে তস্য তস্য নিয়ে মাতবার আসল কারণটাও তাহলে কবুল করি।
আসল কারণ হল এই যে, নিজের যা ভাল লাগে, নিজে যাতে যা আনন্দ পাই স্বাভাবিকভাবে পাঠকদেরও করতে চাই তার ভাগীদার।
আবিষ্কার উদ্ভাবন আর সন্ধানের দুঃসাহসিক বৈচিত্র্যে আমাদের এই শতাব্দীর প্রথম থেকেই বিজ্ঞানের রহস্য রোমাঞ্চ উত্তেজনায় স্পন্দমান।
নিজে যা অনুভব করি বিজ্ঞানের জগতের সেই রহস্য রোমাঞ্চ বিস্ময়ের স্বাদ পাঠকদেরও কিছু দিতে পারি কি না দেখবার জন্যই একটু কৌতুকের সুর মিশিয়ে ঘনাদাকে আসরে নামানো।
বিজ্ঞানের মতো ইতিহাসের রহস্য রোমাঞ্চ উত্তেজনা বড় কম নয়, তার প্রত্যক্ষ স্বাদ নিতে আর দিতে কার শরণ নেব? সত্য যেখানে কল্পনার চেয়েও বিস্ময়কর ও বিশ্বাসের অতীত, পৃথিবীর ইতিহাসের সেই সব আশ্চর্য অধ্যায়ের জীবন্ত পরিচয় পাবার জন্য এবারে ফিরে গেলাম তস্য তস্য অর্থাৎ ঘনাদারই নানা ঊর্ধ্বতন পূর্বপুরুষদেরই কাছে।
–প্রেমেন্দ্র মিত্র
ঘনাদার বাঘ
শিবু প্যাঁচটা ভাল কষেছে।
ক-দিন ধরে হাওয়াটা বেয়াড়া বইছিল।
বাহাত্তর নম্বরের সময়টা এরকম মাঝেমধ্যে একটু আধটু যায় না এমন নয়। যা কিছু করি, গুমোট যেন আর কাটতে চায় না। টঙের ঘরে তাঁকে তখন কিছুতেই বাগ মানানো যায় না। কখনও তিনি কোনও কিছু ঘোষণা ছাড়াই পূর্ণ অসহযোগ চালিয়ে ন্যাড়া ছাদের সিঁড়িতে তাঁর বিদ্যাসাগরি চটি ছোঁয়ানই না। আবার কখনও সকাল বিকেল দুবেলা আমাদের সঙ্গে ওঠবোস করেও মুখে যেন কুলুপ দিয়ে রাখেন। কুলুপ খোলাতে মোগলাই চাইনিজ ফরাসি কতরকম রসুইয়ের কেরামতি যে লাগে তার হিসেব দেওয়া শক্ত।
কিন্তু এবার অবস্থাটা একেবারে আলাদা। আমাদের সেই টঙের ঘরের তিনি নন, তাঁরই চেহারা জাল করে আর যেন কে আমাদের বাহাত্তর নম্বরের উপর ভর করেছেন। চেহারা এক, কিন্তু ভাবগতিক ধরনধারণ সব যেন আলাদা। খাওয়া-দাওয়া সম্বন্ধে তো সে মানুষের পছন্দ অপছন্দের কোনও হদিসই পাওয়া যাচ্ছে না।
যা রাবড়ি পাকিয়েছে দেখে এলাম মোড়ের মিঠাইওয়ালা—আমি হয়তো ক-দিন ধরে চপ কাটলেট কাবাব চিনা-চপসুয়ে ইত্যাদি হার মানবার পর বাইরে থেকে প্রায় হাঁফাতে হাঁফাতে এসে ফলাও করে বর্ণনা করেছি। আমার রসালো বর্ণনা আরও মারাত্মক করে তোলবার জন্য গৌর যেন আমার ওপর খাপ্পা হয়ে ভেংচি কেটে বলেছে, রাবড়ি পাকিয়েছে মিঠাইওয়ালা, তুমি দেখে এলে! তাতেই আমরা কৃতার্থ হয়ে গেলাম, কেমন!