গানাদোর কথা শেষ হবার আগেই উন্মাদের মতো তলোয়ার চালিয়েছে। সোরাবিয়া। সে তলোয়ার গানাদোর কাছেও পৌঁছোয়নি। একটি অদ্ভুত আঘাতে অনেক নীচের ডেকের ওপর ঝনঝন শব্দে আছড়ে পড়েছে।
এইবার তোমার পালা। বজ্রস্বরে বলেছেন গানাদো, আমার তলোয়ারটাও তোমার রক্তে নোংরা করতে চাই না। শেষযাত্রায় গায়ে জড়াবার মতো একটা চাদর শুধু তোমার সঙ্গে দিচ্ছি।
গানাদো পালের মাথার রশিতে কোথায় কী তলোয়ারের ঘা দিয়েছেন কে জানে। সমস্ত পালটা খুলে সোরাবিয়ার ওপর পড়ে তাকে জড়িয়ে নিয়ে বহু নীচের সমুদ্রের জলের ওপর একটা শব্দ তুলে অন্ধকারে অদৃশ্য হয়ে গেছে।
সেদিকে একবার চেয়ে গানাদো ধীরে ধীরে মাস্তুলের মাথা থেকে ডেকের ওপর নেমে এসে হালিকে সোরাবিয়ার ভাড়া করা কেবিনটা কোথায় জিজ্ঞাসা করেছেন।
সে যুগের জাহাজের মাল্লা, অস্ত্রবিদ্যার চেয়ে মানুষের মূল্য আর মর্যাদা মাপবার আরও বড় কোনও কিছু তারা জানে না। কম্পিত সমভরা গলায় হালি কয়া তখনও যেখানে বন্দি সে কেবিনের নির্দেশ জানিয়ে দিয়েছে।
তার মানে, দাসমশাই থামতেই মাথার কেশ যাঁর কাশের মতো শুভ্র সেই হরিসাধনবাবু উৎসুক আশান্বিত কণ্ঠে জিজ্ঞাসা করেছেন, ওই কয়াকে নিয়ে গানাদো শেষ পর্যন্ত দেশে ফিরতে পেরেছিলেন?
তা পেরেছিলেন বইকী! অনুকম্পা-মেশানো গম্ভীর স্বরে বলেছেন দাসমশাই; নইলে আমার নাম ঘনশ্যাম দাস হবে কেন? আর কিছুর জন্যে না হোক কাপিন সানসেদোর কাছে দেওয়া প্রতিশ্রুতি রাখবার জন্যেই তাঁকে ফিরতে হয়েছিল। ভাগ্যচক্রে ক্রীতদাস হয়ে যাঁকে স্পেনে আসতে হয়, আর কাপিন সানসেদো যাঁকে শ্রদ্ধাভরে মুক্তি দিয়ে গুরু হিসেবে বরণ করেন ঋষিতুল্য পরম পণ্ডিত সেই বৃদ্ধ ভারতীয় জ্যোতিষীর অন্তিম লিপি গানাদো অর্থাৎ ঘনরাম দাস সত্যিই যথাস্থানে পৌঁছে দিতে পেরেছিলেন।
কোথায়? কার কাছে? মর্মর মসৃণ যাঁর মস্তক সেই শিবপদবাবু জিজ্ঞাসা না করে পারেননি।
এখনকার কাটোয়ার কাছে ঝামটপুর বলে এক গ্রামে। দাসমশাই শিবপদবাবুর কৌতূহল মেটাতে জানিয়েছেন, কৃষ্ণদাস নামে এক সজ্জনের কাছে।
কী ছিল সেই অন্তিম লিপিতে? এ জিজ্ঞাসা কুম্ভোদর রামশরণবাবুর। যা ছিল তা যথাযথ বলতে পারব না। শ্রীঘনশ্যাম দাস এ কৌতূহলও মিটিয়েছেন, তবে বৃদ্ধ জ্যোতিষী এই রকম কিছু লিখেছিলেন বলে জানি—গণনায় জানতে পারছি ১৪৫৫ শকাব্দের আষাঢ় মাস সমস্ত পৃথিবীর এক দুঃসময়। বিশ্বের অনন্য এক যুগাবতার তিরোহিত হতে চলেছেন ওই সময়ে। পারেন তো সেই পরম জ্যোতির্ময় সত্তার দীপ্ত দিব্যোন্মত্ত জীবনকথা অমর কাব্যে গেঁথে রাখবার চেষ্টা করুন।
১৪৫৫ শকাব্দের আষাঢ় মাস? কুম্ভোদর রামশরণবাবু একটু দ্বিধাভরে জিজ্ঞাসা করেছেন।
হ্যাঁ, ১৪৫৫ শকাব্দের আষাঢ় মাস হল ১৫৩৩ খ্রিস্টাব্দের জুলাই! উদার হয়ে তারিখটার তাৎপর্য বুঝিয়ে দিয়েছেন দাসমশাই, নীলাচলে শ্রীচৈতন্যদেবের তিরোধান ঘটে ওই সময়েই।
একটু থেমে দাসমশাই আবার বলেছেন, কে জানে বৃদ্ধবয়সে বৃন্দাবন প্রবাসী হয়ে তাঁর শ্রীচৈতন্যচরিতামৃত লেখবার প্রেরণা কৃষ্ণদাস কবিরাজ ওই লিপি থেকেই পেয়েছিলেন কিনা!
—–x—–