কিন্তু তখন দেরি হয়ে গেছে একটু বেশি। রাতের অন্ধকার গাঢ় হয়ে তখন নেমে এসেছে পৃথিবীর ওপর। সেই অন্ধকার। উত্তর আকাশের ঈষৎ ফিকে পশ্চাৎপটে সোরাবিয়ার সঙ্গে বন্দিনী কয়াকে যা বয়ে নিয়ে যাচ্ছে সেই জাহাজটার গাঢ় কৃষ্ণ রেখাকৃতি আর তার মধ্যে একটা নাতি উজ্জ্বল আলোর বর্তিকা ক্রমশ দূরে সরে যেতে দেখা গেছে। আর মাত্র কিছুক্ষণ আগে এলে বুঝি এ জাহাজের নোঙর ভোলা বন্ধ করবার চেষ্টা করা যেত।
শ্রীঘনশ্যাম দাস চুপ করলেন আর সেই সঙ্গে সঙ্গে ককিয়ে উঠলেন কুম্ভোদর রামশরণবাবু, ওই পাপিষ্ঠ সোরাবিয়া কয়াকে অমন করে অবাধে লুঠ করে নিয়ে চলে গেল?
না, তা আর যেতে পারল কই! শ্রীঘনশ্যাম দাস আর সকলের তো বটেই, মর্মর মসৃণ যাঁর মস্তক সেই শিবপদবাবুর মুখেও অস্ফুট একটু প্রসন্ন হাসি ফুটিয়ে বললেন, বন্দরের সীমানা ছাড়িয়ে খোলা দরিয়ায় পড়তে না-পড়তে জাহাজের হালি গায়ের ওপর কয়েক ফোঁটা জল পড়ায় চমকে উঠেছে।
মেঘের বাষ্প কোথাও নেই। এমন ঝকঝকে পরিষ্কার আকাশ থেকে জলের ফোঁটা ঝরে কেমন করে?
ওপর দিকে চেয়ে শিউরে উঠেছে হালি। শিউরে উঠেছে সোরাবিয়াও। জাহাজ বন্দর থেকে ছাড়বার পর থেকে এতক্ষণ পর্যন্ত সে ডেকের ওপরেই আছে, নির্বিঘ্নে খোলা দরিয়ায় পৌঁছোনোটুকু দেখে যাবার জন্যে।
খোলা দরিয়ায় পৌঁছোবার পর নিশ্চিন্ত হয়ে এবার সে তার বন্দিনীর খবর নেবার জন্যে ফিরতে যাচ্ছিল। ফেরার মুখেই ওপর থেকে কয়েক ফোঁটা জল পড়তে সে চমকে উঠেছে হালির মতো, তারপর শিউরে উঠেছে ওপর দিকে চেয়ে।
ওপরে যা দেখেছে তাতে নিজের চোখকেই প্রথমত বিশ্বাস সে করতে পারেনি। একেবারে জাহাজের মাথার কাছের পাল ফোর-টপ-সেল-এর আড়াল থেকে একটা অদ্ভুত আবছা ছায়ামূর্তি বেরিয়ে এসেছে।
ছায়ামূর্তি নিছক ছায়া কিন্তু নয়। জলের ফোঁটাগুলো তার গা থেকেই যেন পড়ছে।
এবার।
ফোর-টপ-সেল থেকে মাস্তুলের দড়ি বেয়ে ছায়ামূর্তিটা মিজেন পালের দিকে নেমে এসেছে এবার।
কাঁপা হলেও তীক্ষ্ণ গলায় সোরাবিয়া জিজ্ঞাসা করেছে, কে? কে ওখানে? ছায়ামূর্তিটা তখন টপ-মাস্ট মাস্তুলের কাছে। সেখান থেকে বুকের রক্ত হিম করে দেওয়া গলায় উত্তর এসেছে, তোমার নিয়তি!
মিজেন মাস্তুল বেয়েই মূর্তিটা তারপর খানিকটা নেমে এসে লাফিয়ে পড়েছে। ডেকের ওপর।
তুমি! তুই! ভয় বিস্ময় আর হিংস্র উল্লাস মেশানো একটা অদ্ভুত চিৎকার বেরিয়ে এসেছে সোরাবিয়ার গলা থেকে। তারপর পৈশাচিক একটা অট্টহাসি।
হ্যাঁ আমি, সত্যিই তোমার নিয়তি—সোরাবিয়ার অট্টহাসি থামবার পর জবাব দিয়েছে সে মূর্তি—তোমার সঙ্গে শেষ হিসেব-নিকেশ বাকি ছিল এতদিন। সেই জন্যেই আজ এসেছি।
হিসেব চুকোবার সাধ তোর সত্যিই আজ মিটিয়ে দেব! কোমরের খাপ থেকে একটানে নিজের হিংস্র আক্রোশের মতোই ধারালো তলোয়ারটা খুলে বার করে বলেছে সোরাবিয়া, তুই নিজেকে আমার নিয়তি ভাবছিস? নিয়তি নয়, তুই আমার নিয়তির উপহার। আমার অনেক দিনের দারুণ একটা সাধ মিটিয়ে দেবার জন্যেই তোকে এমন করে আজ পাঠিয়েছে। তা না পাঠালে বন্দর থেকে ছেড়ে-যাওয়া এ জাহাজ সাঁতরে এসে ধরা তোর সাধ্যে কুলোত! নে এবার তৈরি হয়ে, ইষ্টনাম যদি কিছু থাকে তো জপ করে নে! এ আর চার দেয়ালের বন্ধ ঘর নয় যে, নাচের পা চালিয়ে বেঁচে যাবি। এ খোলা জাহাজের ডেক। এই হালিকে সাক্ষী রেখে বলছি, এই ডেকে তোর ঝাঁঝরা করা লাশ আজ শোয়ব।
সোরাবিয়া খোলা তলোয়ার নিয়ে প্রায় লাফ দিয়ে এগিয়ে গেছে এবার! তলোয়ার খুলে দাঁড়িয়েছে সে মূর্তিও। কিন্তু দু-জনের দ্বন্দ্বযুদ্ধের ধরন দেখে মনে হয়েছে, আস্ফালন যা করেছে তা-ই যেন সফল করে দেখিয়ে দেবে সোরাবিয়া।
সোরাবিয়ার নিপুণ আক্রমণে মূর্তিকে ধীরে ধীরে পিছিয়ে যেতে দেখা গিয়েছে। জাহাজের সামনের মাস্তুল ফোর-মাস্টের দিকে। একেবারে প্রায় কিনারা পর্যন্ত গিয়ে আর পেছোবার উপায় নেই বলেই বোধহয় মূর্তিকে এবার সোরাবিয়ার মার ঠেকাবার ফাঁকে ফাঁকে মাস্তুল বেয়ে ওপরে উঠতে দেখা গেছে।
পৈশাচিক উৎসাহে আনন্দে এবার চিৎকার করে উঠেছে সোরাবিয়া। সে দক্ষ নাবিক। পাল মাস্তুলের রাজ্য তার চোখ বুজে ঘোরা ফেরার জায়গা। ছায়ামূর্তির ভড়ংকরা নির্বোধ গানাদো সেই পাল মাস্তুলের জটলার মধ্যে তাকে এড়িয়ে পালাতে পারবে ভেবেছে!
গানাদোর ধরন দেখে উদ্দেশ্যেটা তাঁর সেই রকমই মনে হয়েছে। ফোর-মাস্ট থেকে তিনি টপ-গ্যালান্ট মাস্তুলে গিয়ে উঠেছেন, সেখান থেকে রয়্যাল পালের আড়াল দিয়ে ফোর-রয়্যাল মাস্তুলে।
এর পর আর ওঠবার জায়গা নেই। সোরাবিয়া তার হিংস্র উল্লাস আর চেপে রাখতে পারেনি। অনায়াসে রয়্যাল পালের একটা রশি বাঁ-হাতে ধরে তারই তলার আড়া কানাতে পা রেখে তীব্র অবজ্ঞার স্বরে বলেছে, এখান থেকে সমুদ্রে ঝাঁপ দিয়ে রক্ষা পাবি, ভেবেছিস! ঝাঁপ দিতে হয়তো পারবি, কিন্তু তার আগে এফোঁড়-ওফোঁড় না হয়ে নয়। মিছেই এতটা কষ্ট করলি?
না, মিছে নয়। এতক্ষণ বাদে প্রথম কথা বলেছেন গানাদো, তুমি ডেকের ওপর আমার লাশ শোয়াতে চেয়েছিলে, আমি কিন্তু এ জাহাজ তোমার রক্তে নোংরা করতে চাইনি। তাই তোমায় লোভ দেখিয়ে উঠিয়ে এনেছি এই মাস্তুলের ডগায়। এখান থেকে তোমার লাশটা আর জাহাজের ডেকে পড়বে না, পড়বে সমুদ্রের জলে যা অপবিত্র করার সাধ্য তোমার মতো শয়তানেরও নেই।