সোরাবিয়া গানাদোদের আস্তানা থেকে কয়াকে জোর করে ধরে নিয়ে একটা জাহাজে পালাচ্ছে। এখনও বন্দরে ছুটে গেলে তাকে বাধা দেওয়া যায়। এই হল আনার উত্তেজিত যন্ত্রণাকাতর কণ্ঠের নিবেদন।
বিশ্বাস করা যায় এরকম আজগুবি অসম্ভব সংবাদ।
সোরাবিয়া কোথা থেকে এল এখানে? তীক্ষ্ণ কণ্ঠে অনেকগুলি প্রশ্ন করেছেন। গানাদো, তুমি হঠাৎ এ খবর দেওয়ার জন্যে ছুটে এসেছ কেন? কয়া তো অসাড় গাছ-পাথর নয়। তাকে এই দিনের আলোয় নগরের রাস্তা দিয়ে বন্দর পর্যন্ত নিয়ে। গেল কী করে? জাহাজেই বা তুলল কীভাবে?
এসব প্রশ্ন এখন করবার নয়। আকুল অস্থিল হয়ে উঠেছে আনা, তোমার কয়াকে যদি বাঁচাতে চাও এখনই বন্দরে গিয়ে ধরবার চেষ্টা করো সোরাবিয়াকে।
কয়া-কে বাঁচাবার জন্যে এত ব্যাকুল কখন থেকে হলে! তীব্র বিদ্রূপের স্বরে বলেছেন গানাদো, সোরাবিয়া তো মন্ত্র পড়ে আমাদের হদিস পায়নি। আমাকে ও কয়াকে ধরিয়ে দেবার জন্যে তুমিই তো তাকে সব জানিয়েছ?
হ্যাঁ, জানিয়েছি! কান্না-চাপা গলায় বলেছে আনা, ঈর্ষা আর প্রতিহিংসার জ্বালায় আমি তখন উন্মাদ হয়ে গিয়েছিলাম। বিশ্বাস করো, আজ নিজের জীবন দিয়েও সে ভুল, সে পাপের প্রায়শ্চিত্ত করতে আমি প্রস্তুত! কিন্তু এসব কথায় কাটাবার সময় এখন নেই! তুমি এখনও বন্দরে গেলে হয়তো তাকে ধরতে পারবে। আমায় তুমি যত খুশি ঘৃণা করো, দাস, সেই ঘৃণার ভেতর দিয়েই তোমার মনে একটু জায়গা পেয়ে আমি এখন খুশি থাকব। কিন্তু আমায় তুমি অবিশ্বাস করো না। আর এক মূহূর্ত দেরি না করে তুমি বন্দরে যাও।
গানাদো কিন্তু নিজের সমস্ত প্রশ্নের উত্তর না শুনে সেখান থেকে এক পা নড়েননি। এমনই অবুঝ সর্বনাশা জেদ হয়েছিল তাঁর সেদিন।
অপ্রকৃতিস্থর মতো অস্থির উত্তেজিত কণ্ঠে আনা এবার যা জানিয়েছে তার সার কথা হল এই যে সোরাবিয়া কয়েক দিন আগে পেরু থেকে পানামায় ফেরে। আনার মতো সে-ও মার্কুইস গঞ্জালেস দে সোলিস হিসাবে পানামার গভর্নর-এর অতিথি হয়। বলে দুজনের দেখা হয় আপনা থেকেই। আনার কাছে গানাদোর খবর জানতে পেরে সোরাবিয়া তখনই আনাকে নিয়ে নোমৰ্বে দে দিয়স বন্দরে আসার ব্যবস্থা করে। এখানেই যে গানাদো আর কয়াকে সে ধরতে পারবে এ বিষয়ে তার কোনও সন্দেহ। ছিল না। আগেকার এক সপ্তাহের মধ্যে কোনও জাহাজ বন্দর থেকে ছাড়েনি জেনে সে আরও নিশ্চিন্ত হয়। নিজেকে প্রচ্ছন্ন রেখে সে গোপনে গানাদোর হদিস পাবার চেষ্টা করে। নগরের পথে একদিন ফেলিপিলিওকে দেখে তাকে নিঃশব্দে অনুসরণ করে গানাদোর সন্ধান সে পেয়েও যায়। সেই সঙ্গে কয়াকেও সে দেখে। এবার সে যে শয়তানি মতলব ভাঁজে তা বাহাদুরি করেই হিংস্র বিদ্রূপের সঙ্গে আনাকে জানায়। গানাদোকে ফেরারি গোলাম হিসেবে সে ধরিয়ে দেবে, কিন্তু শুধু তাতেই সে সন্তুষ্ট থাকবে না। কয়াকেও সে লুঠ করে নেবে। আনা যে তার বিবাহিতা স্ত্রী হয়েও গানাদোর প্রেমে হাবুড়ুবু, এ লুণ্ঠন হবে তারই প্রতিশোধ। পানামা থেকে রওনা হবার পর থেকেই নিজের অপরাধের পরিমাণটা বুঝতে পেরে আনা অনুশোচনায় দগ্ধ হতে শুরু করেছে। এবারে সে সোরাবিয়ার বিরুদ্ধে প্রকাশ্যেই বেঁকে দাঁড়ায়। গানাদো যে আর গোলাম নয়, মুক্ত স্বাধীন নাগরিক, সম্রাটের সই করা সনদ দেখিয়ে বন্দরের কোতোয়ালকে তা সে জানিয়ে দেবে বলে। হিতে বিপরীত হয় এ শাসানিতে। সোরাবিয়া প্রথমে আনার কাছ থেকে গানাদোর মুক্তিপত্র জোর করে আদায় করবার চেষ্টা করে। কোথায় আনা সে সনদ লুকিয়ে রেখেছে জানবার জন্যে যতখানি সম্ভব শারীরিক উৎপীড়ন করতে সে দ্বিধা করে না। তা সত্ত্বেও বিফল হয়ে আনাকে প্রায় অজ্ঞান অবস্থায় তাদের এখানকার আশ্রয় নিবাসের একটি ঘরে বন্ধ করে রেখে সোরাবিয়া তার ভাড়াকরা গুণ্ডাদের নিয়ে গানাদোর আস্তানায় হানা দেবার মতলব আঁটতে বসে পাশের ঘরেই। গানাদোর আস্তানায় হানা দিয়ে জোর করে হাত পা মুখ বেঁধে তারা কয়াকে বার করে আনবে। তারপর কফিন-এর বাকসে পুরে মৃতদেহের মতো তাকে বয়ে নিয়ে যাবে বন্দরের দিকে। সেদিকের নির্জন রাস্তায় একবার পৌঁছোতে পারলে থলির মধ্যে ভরা কোনও চালানির মাল হিসেবে কয়াকে জাহাজে তুলে তখনকার মতো সোরাবিয়ার নিজের ভাড়া করা কেবিনে বন্দি করে রাখা মোটেই শক্ত হবে না। এই পরামর্শ করে ভাড়াটে গুণ্ডাদের নিয়ে সোরাবিয়া বেরিয়ে গেছে। প্রতিবেশীদের একজন আনার চিৎকার আর দরজায় আঘাত শুনে যখন এসে তাকে মুক্ত করেছে তখন আনার নিজে থেকে কিছু করবার আর উপায় নেই। এইটেই তাঁর যাতায়াতের পথ জেনে আনা তাই আকুলভাবে গানাদোর জন্যে এখানে অপেক্ষা করে আছে। সোরাবিয়ার পৈশাচিক ষড়যন্ত্র শেষ মুহূর্তে যদি ব্যর্থ করা যায় এই আশায়।
এত কথা শোনবার পরও যদি গানাদো বন্দরের বদলে তাঁর আস্তানাতেই ব্যাপারটা সম্বন্ধে নিঃসন্দেহ হবার জন্যে না ফিরে যেতেন।
আস্তানায় ফিরে গিয়ে নিজের চোখে অবশ্য তিনি রক্তাক্ত মুমূর্ষ ফেলিপিলিওকে দেখেছেন। শেষ নিঃশ্বাস পড়বার আগে শুনেছেন তার ক্ষীণ স্তব্ধপ্রায়, কণ্ঠে সোরাবিয়ার পৈশাচিক আক্রমণের কথা। সেই আক্রমণ ঠেকাবার জন্যেই প্রাণ দিয়ে ফেলিপিলিও তার দেশদ্রোহিতার প্রায়শ্চিত্ত করে গেছে।
কাপিন সানসেদো আর ডন মোরালেস-এর ওপর ফেলিপিলিওর উপযুক্ত সৎকারের ভার দিয়ে গানাদো তারপর বন্দরে ছুটে গেছেন।