অসম্ভব।
এ সব জাহাজে সরকারি কাজের লোক বাদে যারা যায় তাদের ভাড়া যা দিতে হয় তা প্রায় গলা কাটা।
যোজকের ওপার থেকে সোনা ছড়ানো সব জায়গা, বিশেষ করে প্রায় সোনায় বাঁধানো পেরুর মতো দেশ আবিষ্কৃত ও লুণ্ঠিত হতে শুরু হওয়ার পর থেকেই এই
অবস্থা দাঁড়িয়েছে। তাল তাল সোনাদানা যারা লুঠ করে এনে দেশে ফিরছে জাহাজের। নাখোদারা তাদের ওপর মায়া-দয়া করবে কেন? জাহাজে জায়গা পেতে হলে লুঠের। মালের বেশ কিছু ভাগ তাদের দিয়ে যেতে হবে।
সত্যিই লুঠ করে যারা ফিরছে তারা তাই দিতে খুব আপত্তি করে না। কিন্তু গানাদো সেরকম খাঁই মেটাবেন কোথা থেকে। দলের মধ্যে সামান্য যা একটু পুঁজি। আছে তা কাপিন সানসেদোর কাছে। জাহাজ-ভাড়ার সমস্যা এমন হতে পারে অনুমান করতে না পেরে তিনি সঙ্গে বিশেষ কিছু আনেননি। তবু যতটা পারেন তিনি সবই দেন জাহাজের কাপিতানের হাতে। গানাদো আর কয়ার মূল্য বাবদ যা। পেয়েছিল ফেলিপিলিও তাও প্রায় সবটাই ফেরত দেয়। সকলের কাছে সব কিছু। কুড়িয়ে-বাড়িয়েও যা সংগ্রহ হয় তা কিন্তু এক জনের ভাড়ার পক্ষেও যথেষ্ট নয়।
ভাড়া যা দিতে পারবেন না গতরে খেটে তা পুষিয়ে দেবার প্রস্তাব করেও দেখেন গানাদো। কাপিন সানসেদো আর ফেলিপিলিওকে নিয়ে পুরুষ তাঁরা তিনজন। একমাত্র কয়াকে যদি যাত্রিণী হিসেবে জায়গা দেয় তাহলে তাঁরা তিনজনে মাল্লা হিসেবে যে কোনও কাজ করতে প্রস্তুত বলে জানান।
নোমব্রে দে দিয়স বন্দরে আর যা কিছুর হোক, জাহাজের মাঝিমাল্লার অভাব নেই। গানাদোর দলের এ প্রস্তাবে রাজি হবার মতো কোনও জাহাজের কাপিন পাওয়া যায় না।
প্রতিদিন অবস্থা যে গুরুতর হয়ে দাঁড়াচ্ছে তা ভাল করেই বুঝতে পারেন গানাদো। এখন শুধু জাহাজের ভাড়া সংগ্রহই সমস্যা, পরে যে কোনও দিন সমস্যা আরও সঙ্গিন হয়ে উঠতে পারে। মার্কামারা ফেরারি গোলাম হিসেবে তখন জাহাজে ওঠাই অসম্ভব হবে।
আনা এ কয়দিনে তাঁর খোঁজে পানামা তোলপাড় করে ফেলেছে নিশ্চয়। ওপারের হুলিয়া যে এখনও এপারে পৌঁছোয়নি এ-ই ভাগ্য। কিন্তু এ ভাগ্য আর ক-দিন টিকবে!
৩৪. ফেরারি গোলাম বলে চিহ্নিত হয়ে
পানামার হুলিয়া নোমব্রে দে দিয়স-এ পৌঁছেলে ফেরারি গোলাম বলে চিহ্নিত হয়ে এ বন্দর থেকে বার হওয়া তাঁর পক্ষে কঠিন হবে এই ভয় করেছিলেন গানাদো।
তার চেয়ে কত বড় অভাবিত নিদারুণ দুর্ভাগ্য যে তাঁর জন্যে অপেক্ষা করে আছে। তিনি তখন কল্পনাই করতে পারেননি।
নোমব্রে দে দিয়স-এ কয়েক দিন ফিরতি জাহাজে জায়গার খোঁজে হতাশ ভাবে কাটাবার পর সেদিন ফেলিপিলিও একটা আশার খবর এনেছে। সেদিন সকালেই একটি ছোট কারাভেল বন্দরে এসে ভিড়েছে। পানামা থেকে স্পেনে নিয়মিত যে সব জাহাজ যাতায়াত করে তাদের কোনওটি নয়। এ কারাভেল-এর বন্দর-ঘাঁটি হল নিকারাগুয়ার পুণ্টা গোরদা। সেখান থেকে রওনা হয়ে ঝড়ের মুখে বিপথে এসে পড়ে নোমরে দে দিয়স-এ আশ্রয় নিয়েছে শুধু দিনের বেলাটায় কিছু মেরামতি সেরে নেবার জন্যে। সন্ধে বেলাতেই আবার অনুকূল হাওয়ায় রওনা হবে।
এ অঞ্চলের জাহাজ নয় বলে হয়তো তাতে জায়গা পাওয়া অত কঠিন হবে না। কাপিন সানসেদো আর ডন মোরালেসকে নিয়ে গানাদো তাই ভেবে জাহাজের নাখোদার সঙ্গে কথা বলতে গিয়েছেন।
গিয়ে শেষ পর্যন্ত হতাশই হতে হয়েছে। এ জাহাজে কাপিন সানসেদোকে নিয়ে তাঁর ও কয়ার মতো জায়গা ছিল ঠিকই। ভাড়াও তাঁদের সাধ্যের অতিরিক্ত ছিল না। কিন্তু তাঁদের পৌঁছোতে দেরি হয়ে গেছে। সকালবেলা বন্দরে ভিড়বার কিছু পরেই এখানকার একজন সব কটি জায়গাই আগাম মূল্য দিয়ে নিয়ে রেখেছেন।
কে সে লোকটি? না জিজ্ঞেস করে পারেননি গানাদো। সেই সঙ্গে উৎসুকভাবে বলেছেন, হয়তো তাঁর দরকার আমাদের মতো জরুরি নয়। ঠিক মতো বোঝাতে পারলে হয়তো আমাদের জন্যে জাহাজের জায়গা তিনি ছেড়েও দিতে পারেন। আপনি শুধু তাঁর নাম আর পরিচয়টা আমাদের দিন।
নাম আর পরিচয় কি আমি মুখস্থ করে রেখেছি! এবার যেন একটু অধৈর্যই ফুটে উঠেছে জাহাজের নাখোদার গলায়, ভাড়া বুঝে পেয়ে জাহাজে জায়গা কবুল করে দিয়েছি, ব্যস ব্যাপার চুকে গেছে। তা ছাড়া নাম-ধাম মনে থাকলেও আপনাদের বলতাম না। তার বারণ আছে।
আর কথা বাড়ানো বৃথা বুঝে গানাদো মোরালেস আর কাপিতানকে নিয়ে সেখান থেকে চলে এসেছেন। সামান্য একটু দেরির জন্যে এমন একটা বিরল সুযোগ হাতছাড়া হওয়ায় মনটা খিচড়ে গেছে বড় বেশি। তিক্ত হতাশা নিয়ে তিনজনে বন্দর শহরের পুকে পান করবার একটা দোকানে গিয়ে খানিকক্ষণ বসেছেন। সেখান থেকে বার হতে প্রায় সন্ধে হয়ে গেছে।
পুলকে পানশালায় ওই সময়টুকু কাটানোই হয়েছে মারাত্মক ভুল। সর্বনাশ হয়ে গেছে ওই বিলম্বটুকুর মধ্যেই।
সর্বনাশের খবরটা প্রথম পেয়ে বিশ্বাসই করতে পারেননি। বিশ্বাস করা সত্যিই শক্ত।
পানশালা থেকে বেরিয়ে নগর-সীমানায় তখন নিজেদের আস্তানায় দিকে তিনজনে বিষণ্ণ মনে চলেছেন। হঠাৎ দুর থেকে একটি মূর্তিকে ছুটে আসতে দেখে চমকে উঠেছেন গানাদো।
এ কী! এ তো আনা! কিন্তু আলুথালু বেশে অবিন্যস্ত কেশে এমন উন্মাদিনীর মতো চেহারা কেন?
উন্মাদিনীর মতোই ছুটে এসে আনা গানাদোর একটা হাত ব্যাকুলভাবে জড়িয়ে ধরেছে! তারপর হাঁফাতে হাঁফাতে এক নিঃশ্বাসে যা বলেছে তা পাগলের প্রলাপ ছাড়া আর কী হতে পারে?