গানাদো আর তাঁর সঙ্গীরা সে রাস্তা ব্যবহার করতে তো পারেননি। তার উপায় ছিল না। দুর্ভেদ্য বনজঙ্গলের ভেতর দিয়ে তাঁদের নতুন করে পথ খুঁজে নিয়ে পাহাড়ের ওপারে যেতে হয়েছে সমস্ত ব্যাপারটা সম্পূর্ণ গোপন রাখবার জন্যে। এই গোপনতার জন্যেই পানামায় রাত্রের অন্ধকারে এমনই লুকিয়েই তাঁদের মোরালেস-এর বাড়ি ছাড়তে হয়েছিল। কিন্তু কেন এ গোপনতা, এ প্রশ্ন এবার উঠতে বাধ্য।
কাপিন সানসেদোর সঙ্গে অমন দৈবানুগ্রহে আনা-র দেখা হয়ে যাবার পরও পানামা ছাড়তে গানাদোর অমন লুকোচুরির দরকার তো হবার কথা নয়।
স্পেনের রাজধানী টোলেডো থেকে গানাদোর যে মুক্তিপত্র আনা অত আগ্রহভরে সঙ্গে করে এনেছিল তাতে কি তাহলে গলদ ছিল কিছু?
না, তা ছিল না। সে হুকুমনামা টোলেডোর রাজদরবারে মহামান্য কর্টেজ-এর সুপারিশে স্বয়ং সম্রাটের স্বাক্ষরিত।
আনা কি তাহলে শেষ পর্যন্ত গানাদোর হাতে এ মুক্তিপত্র দিতে কাপিন সানসেদোর সঙ্গে ডন মোরালেস-এর আস্তানায় গিয়ে উঠতে পারেনি?
না, তা-ও সে গিয়েছিল। দেখাও পেয়েছিল গানাদোর। কিন্তু মুক্তিপত্র তার হাতে দেয়নি। তার বদলে আহত বাঘিনীর মতো প্রতিহিংসার জন্যে ক্ষিপ্ত হয়ে উঠে গানাদোকে চরম সর্বনাশের জন্যে প্রস্তুত থাকতে বলে ঝড়ের। মতো সেখান থেকে বেরিয়ে গিয়েছিল।
আনার মতো নারীচরিত্রের গহন রহস্য জানা থাকলে কারণটা বোধ হয় আর ব্যাখ্যা করতে হবে না।
আনা আকুল আগ্রহে গানাদের দেখা পাবার আশায় ছুটে এসেছিল মোরালেস-এর বাড়িতে। গানাদোর দেখা পেয়েছিল আর সেই সঙ্গে কয়ারও।
কয়ার কোনও পরিচয় তখনও কেউ দেয়নি। তবু আনা থমকে দাঁড়িয়ে পড়েছিল মোরালেস-এর বাড়ির ভেতর ঢুকে প্রথম তাকে দেখে। কিছুক্ষণ নিস্পন্দ নীরব হয়ে গিয়ে বিবর্ণ মুখে ধরা গলায় গানাদোকে একবার জিজ্ঞাসা করেছিল শুধু, এ কে?
উত্তরের জন্যেও তারপর অপেক্ষা করেনি। হঠাৎ যেন বারুদের স্কুপের মতো বিস্ফোরিত হয়ে হিংস্রকণ্ঠে চিৎকার করে উঠেছিল, এই তোমার পছন্দকরা সুন্দরী? সাত সমুদ্র পারের দেশ থেকে একেই খুঁজে নিয়ে এসেছ তোমার ঘরনি করবে বলে? একে নিয়েই এখান থেকে লুকিয়ে পালাতে চাও? সে স্বপ্ন ভুলে যাও। ফেরারি একটা গোলামের সঙ্গে বুনো বর্বর একটা বাঁদির মিল অত সহজ নয়। তোমার পেয়ারের
সঙ্গিনীকে নিয়ে পানামার এক পা বাইরে কেমন করে তুমি যাও আমি দেখছি।
আগুনের হলকার মতো কথাগুলো মুখ থেকে বার করে আনা আর এক মুহূর্ত সেখানে দাঁড়ায়নি। যেভাবে সে ছুটে বেরিয়ে গেছে তাতে অদম্য ক্রোধ নয়, দুঃসহ কোনও যন্ত্রণাই যেন তাকে তাড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছে বলে মনে হয়েছে।
শুধু গানাদো আর কয়া নয়, সে ঘরে তখন কাপিন সানসেদোর সঙ্গে ডন মোরালেস আর ফেলিপিলিও-ও উপস্থিত। সকলেই স্তম্ভিত বিহ্বল।
শোনো! শোনো, আনা! কাপিন সানসেদোই প্রথম চিৎকার করে ডেকে আনাকে ফেরাবার জন্যে পিছনে ছুটে যাচ্ছিলেন, তাঁকে বাধা দিয়েছিলেন গানাদো।
বলেছিলেন, কোনও লাভ নেই কাপিন। ওকে এখন ফেরাবার চেষ্টা বৃথা। এখন ওর যা মনের অবস্থা, সম্ভব হলে এখনই ও কোতোয়ালি থেকে সেপাই আনিয়ে আমায় ধরাবার ব্যবস্থা করবে।
করতে চাইলেও তা সম্ভব হবে না, ধীর গম্ভীর স্বরে বলেছিলেন ডন মোরালেস, এখন সন্ধে হয়ে এসেছে। পানামা স্পেন নয়। দিনের দায় চুকলে সারা রাত সজাগ পাহারায় খোলা থাকবার মতো কোতোয়ালি স্পেনের শহরেই মেলে না, তো এখানে! কাল সকালের আগে কোতোয়ালি থেকে হামলার ভয় তাই নেই। যেমন করে হোক আজ রাত্রেই পানামা ছাড়বার ব্যবস্থা কিছু করতে হবে?
আপনি যত তাড়াতাড়ি সম্ভব আপদ বিদায় করতে চান, কেমন? কাপিন সানসেদো তিক্তস্বরে বলেছিলেন ডন মোরালেসকে।
তার উত্তরে এবার একটু হেসেছিলেন ডন মোরালেস। হেসে বলেছিলেন, ঠিকই বুঝেছেন, কাপিন। আপদ যাতে ঠিক মতো বিদায় হয় তার জন্যে নিজেও সঙ্গে গিয়ে মাঝখানের পাহাড়টা পার করে দিতে চাই।
আপনি আমাদের সঙ্গে যেতে চান? সত্যিই বিস্মিত হয়ে জিজ্ঞাসা করেছিলেন গানাদো।
হ্যাঁ, এ পাহাড় পার হবার একটা গোপন রাস্তা নইলে তোমাদের চেনাবে কে? প্রসন্ন কণ্ঠে বলেছিলেন ডন মোরালেস।
সত্যিই তাই চিনিয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন ডন মোরালেস। দুর্গম হলেও সম্পূর্ণ অজানা একটি পথ। এ পথ ডন মোরালেসকেও পুরনো স্মৃতি হাতড়ে খুঁজে বার করতে হয়েছে। একদিন তিনি ফ্রানসিসকো পিজারোর সঙ্গে এই পথেই পাহাড় পার হয়ে প্রথম পশ্চিমের অকূল সমুদ্র দেখে আবার ফিরে গিয়েছিলেন। সম্পূর্ণ না হলেও কিছুটা তাঁর মনে ছিল। পথ হিসেবে এটি অবশ্য সহজ সুগম নয়। এর চেয়ে সহজ পথ তারপর আবিষ্কৃত হয়ে এপার-ওপার যাতায়াতের সুবিধে করে দিয়েছে। এ দুর্গম পথের একমাত্র সুবিধা এই যে তা সম্পূর্ণ নিরাপদ। এ পথে কোনও পাহারাদারের নজরে পড়বার কোনও ভয় নেই।
ডন মোরালেস গানাদোর দলকে শুধু নিরাপদ পথ চিনতেই সাহায্য করেননি, কয়ার বাহন হিসেবে একটি ঘোড়াও সঙ্গে আনবার ব্যবস্থা করেছিলেন।
কিন্তু এত চেষ্টা এত কষ্ট সবই বৃথা মনে হয়েছে নোমব্রে দে দিয়স-এ কয়েকটা দিন কাটাবার পর। স্পেনে ফিরে যাবার জাহাজের সমস্যা যে এমন নিদারুণ হতে পারে, তাঁরা ভাবতে পারেননি।
বন্দরে কোনও জাহাজ নেই এমন নয়। মাঝে মাঝে দু-একটা জাহাজ স্পেনে ফেরবার জন্যে পাড়িও দিচ্ছে। কিন্তু গানাদোর মতো মানুষদের তাতে জায়গা পাওয়া