সেভিল বন্দরে পৌঁছোবার জন্যে স্পেনের দক্ষিণের গুয়াদালকুইভির-এর নদীমুখে পৌঁছোবার আগেই সোরাবিয়া তার শয়তানির মোক্ষম চাল চলেছে। গানাদো সম্ভ্রান্ত কাবালিয়েরোর ছদ্মবেশে পলাতক একজন ক্রীতদাস বলে ঘোষণা করে অবিলম্বে তাকে বন্দি করা হোক বলে দাবি করেছে কাপিন সানসেদোর কাছে। হাতে অকাট্য প্রমাণ যা ছিল তা রহস্যজনকভাবে খোয়া গেছে, তবু কাপিন সানসেদো বৃথাই গানাদোর হয়ে এ মিথ্যা অভিযোগ খণ্ডন করবার চেষ্টা করেছেন। কোনও উপায় আর নেই জেনে সেভিল-এ জাহাজ লাগবার আগেই রাতের অন্ধকারে গুয়াদালকুইভির-এর জলে নিঃশব্দে নিজেকে ভাসিয়ে দিয়েছেন গানাদো।
অপমানের জ্বালায় উন্মত্ত হয়ে গিয়েছিল আনা। একটু প্রকৃতিস্থ হবার পর নিজের প্রতিহিংসা চরিতার্থ করবার জন্যে কী নিদারুণ মূল্য তাকে দিতে হয়েছে বুঝতে পেরে স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছে বিহ্বল-বেদনায়। তার নীচ পৈশাচিক চক্রান্তের মন্ত্রী ও সহায় সোরাবিয়ার সঙ্গে যে সে তখন বিবাহের বাঁধনে বাঁধা।
গানাদোর দাসত্ব থেকে মুক্তির সনদই শুধু চুরি করেনি সোরাবিয়া, স্পেনের দরবারে তার সম্বন্ধে লেখা কর্টেজ-এর উচ্ছ্বসিত চিঠিটিও হাত করেছে সেই সঙ্গে। সেই চিঠির ওপর একটু জালিয়াতির বিদ্যে খাটিয়ে তাই দিয়ে অসাধ্য সাধন করাও সম্ভব হয়েছে সোরাবিয়ার পক্ষে। সুদূর সাগরপারে টেনচটিক্লন বিজয়ে কর্টেজকে কল্পনাতীত সাহায্য করার স্বীকৃতি হিসেবে সামান্য সোরাবিয়া এক মুহূর্তে হয়ে গেছে। মার্কুইস গঞ্জালেস দে সোলিস।
নিজের অপরাধের গ্লানিতে অনুশোচনায় তখন দগ্ধ হচ্ছে আনা। সোরাবিয়ার সঙ্গে তার সম্পর্কটা দাঁড়িয়েছে চরম ঘৃণা ও বিদ্বেষের। যে অন্যায় সে করেছে তার প্রতিকার করবার জন্যে আনা তখন ব্যাকুল। সেই জন্যেই কাপিন সানসেদোকে সে আকুলভাবে খুঁজেছে। চেয়েছে গানাদোর কাছে অকপটে নিজের সব কথা জানাতে।
নিষ্ঠুর কৌতুকে তার ভাগ্য আশা দিয়েও সে সুযোগ ছিনিয়ে নিয়েছে। শেষ পর্যন্ত আনা মরিয়া হয়ে টোলেডোর রাজদরবারেই গিয়ে উপস্থিত হয়েছে সব অপরাধ স্বীকার করে সোরাবিয়ার অবিশ্বাস্য জালিয়াতি প্রকাশ করে দেবার সংকল্প নিয়ে। সেখানেই মেক্সিকো বিজয়ী কর্টেজ-এর সঙ্গে তার দেখা। কর্টেজ নিজে তখন কর্ডোভায় এক প্রতারকের যথার্থ পরিচয় হঠাৎ স্মরণ করতে পেরে রাগে অগ্নিশর্মা হয়ে টোলেডোতে এসেছেন সে পাষণ্ডের উপযুক্ত শাস্তির ব্যবস্থা করতে।
রাজদরবারে আনার অপরাধী হিসেবে আত্মসমর্পণের দরকার হয়নি। মার্কুইস গঞ্জালেস দে সোলিস রূপী সোরাবিয়ার জালিয়াতি ধরিয়ে দিয়ে কর্টেজ তার বিরুদ্ধে পরোয়ানা জারি করিয়েছেন আর সেই সঙ্গে গানাদোর দাসত্ব থেকে মুক্তির সনদ নতুন করে রাজ-দপ্তর থেকে বার করিয়ে আনার হাতেই দিয়েছেন গানাদোর কাছে পৌঁছে দেবার জন্যে।
সেই সনদ নিয়ে আনা একাই পানামায় এসেছে পরম দুঃসাহসে। একদিন যেখানে গানাদোর দেখা পেয়েছিল আবার সেখানে হয়তো পেতে পারে এই তার আশা। সে আশা এ পর্যন্ত সফল হয়নি। তবু ধৈর্য ধরে ভেতরের কী যেন এক দুর্বোধ আশ্বাসে আনা পানামাতেই অপেক্ষা করেছে এতদিন।
অন্তরের আশ্বাস যে তার মিথ্যা নয়, কাপিন সানসেদোর সঙ্গে অপ্রত্যাশিত এই সাক্ষাতেই তার প্রমাণ পাওয়া গেছে।
সমস্ত সমস্যা মিটে গিয়ে সব মুশকিল এবার আসান হবে ধরে নেওয়া উচিত। আনার কাছে গানাদোর দাসত্বমোচনের ফারমান। তার জোরে গানাদো নির্ভয়ে কয়াকে নিয়ে পানামা যোজকের মাঝখানের পর্বতপ্রাচীর ডিঙিয়ে আতলান্তিকের উপকূলের প্রথম-বন্দর নোমব্রে দে দিয়স থেকে ইউরোপের দিকে যখন খুশি পাড়ি দিতে পারবেন।
কিন্তু তা সম্ভব হয় কই? আশাতীত সৌভাগ্যরূপে যা দেখা দেয়, নিয়তির নিষ্ঠুর পরিহাসে তাই চরম দুর্ভাগ্য হয়ে দাঁড়ায় দু-দণ্ড না যেতে যেতে। তা না হলে বুক ফুলিয়ে নির্ভয়ে প্রকাশ্যে যাঁর রওনা হবার কথা সেই গানাদোকে সে রাত্রেই চোরের মতো কয়াকে নিয়ে পানামা ছাড়বার চেষ্টা করতে হয় কেন!
৩৩. বন্দরের নাম নোমব্রে দে দিয়স
বন্দরের নাম নোমব্রে দে দিয়স অর্থাৎ ভগবানের নাম। নাম ভগবানের হলেও জায়গাটা গানাদো আর তাঁর সঙ্গীদের কাছে শয়তানের মুল্লুকই হয়ে দাঁড়িয়েছে।
এই বন্দরে পুরো দু-হপ্তা ধরে হা-পিত্যেশ করে তাঁরা অপেক্ষা করে আছেন স্পেনে বা ইউরোপের যে কোনও জায়গায় ফিরে যাবার একটা জাহাজের যাত্রী হবার সুযোগের জন্যে। তাঁদের যত তাড়াতাড়ি সম্ভব কোনও জাহাজে রওনা হওয়া দরকার ছিল। যত দিন যাচ্ছে ধরা পড়ার বিপদ তত বাড়ছে। কিন্তু কোনও জাহাজে জায়গা পাবার আশাই আর দেখা যাচ্ছে না।
পানামা যোজকের পার্বত্য মেরুদণ্ড পার হবার সময় এই বিপদটার কথা গানাদো বা তাঁর দলের কেউ কল্পনা করতে পারেননি। নোমব্রে দে দিয়স-এ পৌঁছোলে আর কোনও ভাবনা থাকবে না এই ছিল তাঁদের দৃঢ় বিশ্বাস।
দুর্গম পথে পানামা থেকে পাহাড় ডিঙিয়ে লুকিয়ে ওপারের বন্দর নোমব্রে দে দিয়স-এ পৌঁছোনো সত্যিই ছিল প্রায় অসাধ্য।
পানামা যোজকের এপারে-ওপারে যাওয়া-আসার একটা সরকারি পথ তখন চালু হয়ে গেছে। তৈরি করা বাঁধানো রাস্তা না হলেও তা আগাগোড়া চিনে যাবার মতো করে চিহ্ন দেওয়া। দক্ষিণে পেরু আর উত্তরে ছোট ছোট রাজ্যে অভিযান শুরু হওয়ার পর থেকে সে রাস্তায় অল্পবিস্তর লোক চলাচলেরও কামাই নেই।