গানাদো নীরবেই আনার কথা শুনেছিলেন। মতামত কিছু দেননি।
কাপিন সানসেদোর কিন্তু আনার যুক্তিটা মনে ধরেছিল। তিনি মজার ব্যাপারটায় সায় দিয়েছিলেন। সত্যিই ব্যাপারটা যে এক রকমের ষড়যন্ত্র আর তাতে আনার আসল উদ্দেশ্য যে ভিন্ন, তা স্নেহান্ধ কাপিন সানসেদো আর কেমন করে জানবেন!
আনার আসল উদ্দেশ্য যে কী তা গানাদো সেই রাত্রেই বুঝতে পেরেছিলেন। তার আগে জাহাজের ওপর বেশ নাটকীয় উত্তেজনার সৃষ্টি হয়েছে সত্যিই। তখনকার দিনে বাঁদর খেলাবার ড়ুগড়ুগির আকারের বালি রাখা কাঁচের পাত্র দিয়ে সময়ের মাপ হত। মাঝখানের সরু ফুটো দিয়ে ঘড়ি-গেলাসের একদিকের বালি সব আর-একদিকে গিয়ে ঝরে পড়তে সময় লাগত আধঘণ্টা। আধ ঘণ্টা অন্তর ঘড়ি বাজিয়ে সময় জানানো হত তাই।
সেদিন মাঝরাতে প্রহর জানানো ঘণ্টা বাজবার পর জাহাজের ওপরে একটা হুল্লোড় শুরু হয়ে গিয়েছিল। মাঝিমাল্লারা কাপিনের অনুমতি আর প্রশ্রয় পেয়ে সমস্ত জাহাজ তোলপাড় করে তুলেছিল কাবালিয়েরোদের খোঁজে।
গানাদো বাদে পুরুষ কাবালিয়েরো তো মাত্র চারজন। সালাজার, কিনেরো মায় সোরাবিয়াকে নিয়ে একে একে ধরা পড়েছিল সবাই। শুধু সেনর দাস নামে পরিচিত গানাদোরই খোঁজ পাওয়া যায়নি।
তন্নতন্ন করে জাহাজের সব জায়গা খুঁজে দেখা হয়েছে। সোরাবিয়া ও সালাজারের মতো কাবালিয়েরোদের মধ্যে যারা ধরা পড়েছিল তারাও গানাদোর তল্লাশে মাঝিমাল্লাদের সঙ্গে যোগ দিয়েছে! জাহাজের ওপর একটা ইঁদুর লুকোবার জায়গাও বুঝি তারা না দেখে ছাড়েনি।
জাহাজ বলতে এখনকার বিশ-পঁচিশ হাজার টনের সমুদ্রে ভাসানো শহর তো নয়। ওজনে সত্তর-আশি টন আর লম্বায় বড়জোর হাত ষাটেক পালতোলা জাহাজ আজ যা আমাদের কাছে সামান্য সুলুপ মাত্র।
এ জাহাজ থেকে মানুষটা অমন অদৃশ্য হল কী করে?
কাপিন সানসেদো পর্যন্ত একটু চিন্তিত হয়ে উঠেছেন। উদ্বেগ যদি কিছু হয়ে থাকে আনার মুখে অন্তত তা ফুটে ওঠেনি।
ঘড়ি-গেলাসের বালি আবার সব নীচের খোপে ঝরে পড়েছে। মাঝরাতের পর ঘড়ি বাজানো হয়েছে আর আধঘণ্টা কেটে যাবার।
হঠাৎ চঞ্চল হয়ে উঠেছে জাহাজের মাঝিমাল্লা সবাই।
নিস্পন্দ জাহাজ কি এবার তাহলে নড়বে? আকাশের স্তব্ধ হাওয়া কি আবার বইতে শুরু করেছে? নইলে জাহাজের পাল হঠাৎ দুলে উঠবে কেন?
সকলে উৎসুক আগ্রহে ওপরে তাকিয়ে দেখেছে। কৃষ্ণপক্ষের বিলম্বিত ভাঙা চাঁদের আলোয় ভুতুড়ে ওড়নার মতো জাহাজের ঝোলা পালগুলো অস্পষ্টভাবে তখন দেখা যাচ্ছে। তার মধ্যে হঠাৎ একটা ছোট পাল অমন দুলে উঠেছে কেন? ওটা তো যাকে বলে ফোর-টপ-সেল। শুধু ওই পালটিই দুলে ওঠবার কারণ কী?
রহস্যটা পরিষ্কার হয়ে গেছে পরের মুহূর্তে। ফোর-টপ-সেল-এর দড়ি বেয়ে একটা ভুতুড়ে ছায়াকেই যেন নামতে দেখা গেছে। ডেকের ওপর এসে দাঁড়াবার পর চেনা গেছে যে, সে সেনর দাস ছাড়া আর কেউ নয়। ব্যবহারের গুণে আর জুয়ায় অসামান্য বাহাদুরির দরুন গানাদো আগে থেকেই মাঝিমাল্লাদের প্রিয় হয়ে উঠেছিলেন, এখন তাঁর এই নতুন কৃতিত্বে খুশি হয়ে সবাই তাঁকে ঘিরে ধরেছে। অমন একটা লুকোবার জায়গা তিনি যে বেছে নিয়েছেন এইটেই তাঁর বাহাদুরি।
চারিদিকে ভিড় করে গানাদোর তারিফ যারা করেছে তাদের মধ্যে জাহাজের দু-তিন জনকে শুধু দেখা যায়নি। পুরুষদের মধ্যে দেখা যায়নি সোরাবিয়া আর ফ্রানসিসকান পাদরিবাবাকে, আর লুকোচুরির এ নাটকীয় খেলা যার মাথা থেকে বার হয়েছে, সেই আনাই সেখানে অনুপস্থিত।
এমন সময় কোথায় গেল আনা? সারাদিনের উৎসাহ-উত্তেজনায় হয়তো অতিরিক্ত ক্লান্ত হয়েই আনা আর অপেক্ষা করতে না পেরে তার কামরায় ঘুমোতে গেছে মনে করে কাপিতান তার খোঁজ আর করেননি। করলে রীতিমত স্তম্ভিত হতেন। জাহাজে কামরা বলতে মাত্র আড়াইটি বলা যায়। একটিতে সরকারি কাগজপত্র আর মেক্সিকো থেকে সম্রাটের জন্য পাঠানো সোনা-দানার সম্পদ নিয়ে কাপিন সানসেদো থাকেন, আর একটিতে প্রৌঢ়া পরিচারিকাকে নিয়ে সেনোরা আনা। স্বয়ং কর্টেজ যাকে নিরাপদে পৌঁছে দেবার জন্যে চিঠি দিয়েছেন সেই সেনর দাসের জন্যে কাপিন সানসেদো যে জায়গার ব্যবস্থাটুকু করতে পেরেছেন তাকে। সেকালের হিসেবেও কামরা বলা যায় না। প্রায় কুঁজো হয়ে ঢুকে কোনওরকমে একটু গড়াবার সেটা একটা গুহা-গোছের খুপরি মাত্র।
কাপিন সানসেদো তাঁর আদরের সোব্রিনার খোঁজ করলে তাকে তার নিজের কামরায় পেতেন না, সেই রাত্রে নিজের গুহার মতো খুপরি কামরায় ঢুকে কেন যে গানাদো হঠাৎ চমকে নিস্পন্দ হয়ে গিয়েছিলেন তা-ও পারতেন না কল্পনা করতে।
সেই রাত্রে ওই সংকীর্ণ কামরার মধ্যে কী? ঘটেছিল আনা সেইটুকুই শুধু পানামার বাজারের রাস্তায় কাপিন সানচেদোকে সবিস্তারে বলতে পারেনি। এইটুকু শুধু বুঝতে দিয়েছে যে, গানাদোর কাছে তার পক্ষে কল্পনাতীত কঠিন প্রত্যাখ্যান পেয়ে দলিতা ফণিনীর চেয়ে সে হিংস্র হয়ে উঠেছে তারপর। তার দেহ-মনের এ দুঃসহ বহ্নি-জ্বালার কুমন্ত্রণায় ইন্ধন জুগিয়েছে সোরাবিয়া। সাধারণ অবস্থায় যাকে ঘৃণার চোখেই দেখত সেই সোরাবিয়ার সঙ্গেই সে হাত মিলিয়েছে গানাদোর বিরুদ্ধে প্রতিশোধ নেবার জন্যে।
দু-এক দিনের মধ্যেই ঝড় তুফান হয়ে আবার তাদের জাহাজ সচল হয়েছে। স্পেনের বন্দরে পৌঁছোবার আগেই কিন্তু গানাদোর চরম সর্বনাশ হয়ে গেছে আনা। আর সোরাবিয়ার মিলিত শয়তানিতে। গানাদো কর্টেজের স্বাক্ষরিত তাঁর দাসত্ব থেকে মুক্তির সনদ খুঁজে পাননি। কাপিন সানসেদো খুঁজে পাননি তাঁর কাছে সেনর দাস সম্বন্ধে লেখা কর্টেজের চিঠি।