মোরালেস-এর আশ্রয় এক রাত্রের মধ্যে ছেড়ে যাওয়ার কঠিন ও বিপজ্জনক সংকল্পই তাই তিনি নিয়েছেন।
সে সংকল্প সফল হওয়ার ব্যাপারে ভাগ্যের অপ্রত্যাশিত সাহায্যই যেন পাওয়া গেছে। কাপিন সানসেদো ফেলিপিলিওর কাছে যা শুনেছিলেন, তা বেশ একটু ভীত ও ভাবিত করবার মতোই! নগরে আর এক-রাত্রের বেশি নিরাপদ আশ্রয় যার নেই, সেই গানাদোকে ধরবার জন্যে পানামা থেকে যাওয়া আসার সমস্ত পথে কড়া জাগ্রত পাহারার ব্যবস্থা করা হয়েছে জানলে শঙ্কিত বিহ্বল হওয়ারই কথা।
সে শঙ্কা-বিহ্বলতা আশ্চর্যভাবে কেটে গিয়েছে প্রায় তৎক্ষণাৎ।
ফেলিপিলিওর সঙ্গে নগর থেকে বন্দরে যাবার পথের বাঁকে যাকে দেখে কাপিন সানসেদো চমকে উঠেছিলেন, আশঙ্কার জায়গায় আশার সঞ্চার করবার মূল সে-ই।
প্রথম চমকে ওঠবার পর উচ্ছ্বসিত উত্তেজিতভাবে কাপিন সানসেদো তার সঙ্গে যে আলাপ করেছেন তাতে কয়েক মূহূর্তের মধ্যেই একটা দুর্বোধ রহস্যের ব্যাখ্যা পাওয়া গেছে আর সেই সঙ্গে সবচেয়ে কঠিন সমস্যার আশাতীত সমাধান হাতের মুঠোয় এসে গেছে বলে মনে হয়েছে।
অসম্ভব যার দরুন এক মুহূর্তে সম্ভব হয়ে ওঠে কে সে জন?
এমন কেউ যাকে পানামার ওই বাজারের রাস্তায় দেখবার কথা কাপিতান সানসেদো কল্পনাও করেননি। পরস্পরের প্রথম উচ্ছ্বসিত ব্যাকুল সম্ভাষণের পর বিশ্বাসও করতে পারেননি তার কথা।
যার ব্যাকুল আবেদনে সাড়া দিতে গিয়েও বিফল হয়ে বেশ একটু বেদনা নিয়ে সেভিল থেকে চলে আসতে বাধ্য হয়েছিলেন, চপল চঞ্চল খেয়ালি হলেও তাঁর একান্ত আদরের ভাগিনেয়ী সেই আনার দেখা যে হঠাৎ সুদূর পানামার এই বিশেষ সময়টিতে পেতে পারেন, তা কাপিন সানসেদো সত্যি কেমন করে কল্পনা করবেন! গানাদোর জন্যে সমস্ত পানামায় কড়া নজর রাখার ব্যবস্থা যে আনারই কাজ তা বিশ্বাস করাও তাঁর পক্ষে সহজ নয়।
আনা তাঁকে সমস্ত বৃত্তান্ত সবিস্তারে এর পর জানিয়েছে। সব কিছু শোনবার পর স্তম্ভিত হয়েই তিনি কিছুক্ষণ কোনও কথা বলতে পারেননি। আনা তাঁকে যে অবিশ্বাস্য বিবরণ শুনিয়েছে তা ভাল করে ধারণা করতেই যেন তাঁর অনেকখানি সময় লেগেছে।
তিয়ো সানসেদোর কাছে কোনও কথাই আনা এবার গোপন করেনি। কাপিন সানসেদোর অধীন মেক্সিকো থেকে স্পেনে ফেরবার সেই জাহাজেই সমস্ত কাহিনীর সূত্রপাত! সেই জাহাজে গানাদোকে দেখে দুর্বার এক আকর্ষণ অনুভব করেছিল আনা। সব বিচার বুদ্ধি সংযম ভাসিয়ে দেবার মতো আকর্ষণ। সেনর দাস হিসাবে গানাদোর যেটুকু পরিচয় তখন সে জানে তাতে তাঁকে মূর রক্ত মেশানো কোনও খানদানি হিড্যালগোই মনে করেছিল। হৃদয়ের প্রচণ্ড ক্ষুধায় জর্জর ভাগ্য-বঞ্চিত এক যুবতী। অপদার্থ নিষ্ঠুর দায়িত্বহীন এক পাষণ্ডের সঙ্গে বিয়ে হবার পর স্বামীর সঙ্গটুকুও আনা পায়নি। আনাকে বিয়ে করেই তার স্বামী লুঠতরাজ আর অবাধ উচ্চুঙ্খল জীবনের লোভে পাড়ি দিয়েছিল মেক্সিকোতে। সেখান থেকে তার নানা কুকীর্তি ও পরে মৃত্যুর উড়ো খবর আনার কাছে পৌঁছেছিল। মামা কাপিন সানসেদোর সাহায্য নিয়ে পরম দুঃসাহসভরে আনা মেক্সিকো পর্যন্ত গিয়েছিল স্বামীর খোঁজ করতে। স্বামীর মৃত্যুর খবর পাকা জেনে কাপিন সানসেদোর জাহাজে স্পেনে ফেরার পথে ওই সাক্ষাৎ। আনা যেমন করে তোক গানাদোকে জয় করতে চেয়েছিল! ছলাকলা চাতুরী কিছুই প্রয়োগ করতে সে দ্বিধা করেনি। গানাদোর কাছে কোনও উৎসাহ পায়নি, কিন্তু তার আত্মসংযমের বর্ম শেষ পর্যন্ত ভেদ করতে পারবেই এ আত্মবিশ্বাস আনার ছিল। গানাদোর সংযমের বর্ম ভেদ করবার জন্যে সে ফন্দি যে করেছিল, তা সত্যিই চতুর।
সোরাবিয়ার সঙ্গে গানাদোর সেই স্মরণীয় জুয়া খেলার দিনই সে না জানার ভান করে কাপিন সানসেদোর ঘরে ঢুকে পড়ে গানাদোর সঙ্গে পরিচিত হয়ে আলাপ করবার সুযোগ নেয়। হাওয়া বন্ধ হয়ে তাদের পালতোলা জাহাজ তখন মাঝদরিয়ায় অচল হয়ে আছে। সবার হাতেই অঢেল সময়। সময় কাটানোই দায়। গানাদোর সঙ্গে সোরাবিয়ার জুয়া খেলার ব্যবস্থাটা সেই জন্যেই সম্ভব হয়েছিল।
তার তিয়ো অর্থাৎ মামা সানসেদোর ঘরে ঢুকে আনা কৌতুকে উজ্জ্বল মুখে একটা ষড়যন্ত্রের কথা বলেছিল সেদিন। সত্যিই ষড়যন্ত্র কিছু নয়, আসলে অচল জাহাজের জীবনের একঘেয়েমি কাটাবার জন্যে গোপন একটা নাটকীয় মজার ব্যবস্থা।
মজার ব্যবস্থাটা এই—সেদিন মাঝরাতে পাহারার ঘড়ি বাজাবার পর আধঘণ্টা ধরে জাহাজের কাবালিয়েরো মানে ভদ্রবংশের সবাইকে বেমালুম লুকিয়ে থাকবার চেষ্টা করতে হবে। আধঘণ্টা পর্যন্ত ধরা না পড়ে লুকিয়ে থাকতে পারাটাই হবে পরম বাহাদুরি। কাপিন সানসেদো আর আনা হবে সমস্ত ব্যাপারটার দর্শক। ও বিচারক। আর খোঁজাখুঁজি করবে মাঝিমাল্লারা। ধরা পড়লে কাবালিয়েরোদের গুনোগার দিতে হবে আর সেই গুনোগার যে খুঁজে পেয়েছে সে পাবে বকশিশ হিসেবে।
ব্যাপারটাকে ষড়যন্ত্র বলার একটা জুতসই কৈফিয়তও দিয়েছিল আনা। কোনও কাজকর্ম না থাকায় সমুদ্রে যেন শিকড় গেঁথে জমে যাওয়া জাহাজে মাঝিমাল্লারা ক্রমশ ধৈর্য হারিয়ে অস্থির হয়ে পড়ছে। জুয়াতেও তাদের. আর মন ভরছে না। এরকম অবস্থায় আর এক-আধ দিন কাটাতে হলে হয়তো মাথায় কোনও কুবুদ্ধির পোকা ঢুকে তারা বেয়াড়া হয়ে উঠতে পারে। তাদের চাগিয়ে তোলবার জন্যে তাই এই ধরনের একটু মজার উত্তেজনা হয়তো দরকার।