গানাদো বা কয়াকে নয়, সেই টহলের মধ্যে হঠাৎ সেদিন কাপিন সানসেদোকে দেখে সে চিনতে পারে। চিনতে পেরে কী যে করবে তাই প্রথমটা স্থির করে উঠতে পারে না। সে মনে রাখলেও গোেলামের ব্যাপারীর দালাল যে তাকে মনে রেখেছে তার ঠিক কী! মনে রাখবার কোনও গরজই তার নেই। ডেকে কথা বলার চেষ্টা করলে হয়তো চিনতেই পারবে না। আর চিনুক না চিনুক, তার সঙ্গে ফেলিপিলিও কী বলে প্রথম আলাপই বা করতে পারে! জাহাজঘাটায় সেদিন যাদের কিনেছে তাদের সম্বন্ধে হঠাৎ অমন খোঁজ নিতে গেলে ব্যাপারটা সন্দেহজনক হবে না? তাতে হিতে বিপরীতও তো হতে পারে। সমস্যা কঠিন হলেও ফেলিপিলিও শেষ পর্যন্ত মরিয়া হয়ে কাপিতানকে পেছন থেকে ডেকে থামায়। তারপর বিনীতভাবে বলে, মাপ করবেন সেনর, আপনাকে একটা কথা জিজ্ঞাসা করতে পারি?
প্রথমটা চমকে বেশ একটু বিরক্তির সঙ্গে ফিরে দাঁড়ালেও কাপিন সানসেদো একটু লক্ষ করেই ফেলিপিলিওকে চিনতে পারেন। চিনে রীতিমতো অবাকই হন, যাকে তিনি খুঁজছেন সে-ই নিজে থেকে তাঁকে ডেকে থামিয়েছে দেখে। বিস্ময়টা গোপন করে তিনি ফেলিপিলিওকে বিমূঢ় করে দিয়ে গম্ভীর স্বরে বলেন, হ্যাঁ, তোমার নাম যদি ফেলিপিলিও হয় তাহলে পারো।
আমার নাম যে ফেলিপিলিও তা—বিস্ময়ে ফেলিপিলিও ওর বেশি কিছু বলতে পারে না।
কেমন করে আমি জানলাম ভাবছ তো? এবার হেসে বলেন সানসেদো, আমার সঙ্গে এলেই জানতে পারবে।
ফেলিপিলিওকে পথে যেতে যেতে সানসেদো এবার সমস্ত বিবরণ শুনিয়ে তাঁদের সেইদিনই পানামা ছেড়ে যাবার ব্যবস্থার কথাও জানান।
কিন্তু এখন আর তা যাওয়া তো সম্ভব নয়। এতক্ষণ নীরবে সব শোনবার পর ফেলিপিলিও বিষণ্ণভাবে মাথা নেড়ে জানায়।
কেন নয়? সানসেদো একটু উষ্ণস্বরেই বলেন, ধরা পড়ার বিপদের কথা যদি বলো তাহলে তা তো বরাবরই আছে ও থাকবে। আজ হঠাৎ সে বিপদ তো নতুন করে দেখা দেয়নি।
তা দেয়নি, ফেলিপিলিও বিনীতভাবে জানায়, কিন্তু সে বিপদ আর কারও পক্ষে না হোক, গানাদোর পক্ষে এখন গুরুতর।
বিপদ গুরুতর বেছে বেছে শুধু গানাদোর পক্ষেই?সানসেদোর কণ্ঠে অবিশ্বাসের সঙ্গে বিরক্তিই ফুটে ওঠে, পানামা শহর গোলাম বলতে শুধু গানাদোকেই জানে? আর যত আক্রোশ শুধু তার ওপর!
আক্রোশ কি না জানি না! ফেলিপিলিও এবার তার বক্তব্যটা বিশদ করবার চেষ্টা করে, কিন্তু দু-চারদিন ধরে পানামা শহরের সমস্ত আসা-যাওয়ার রাস্তায় গানাদোর মতো একজন গোলামের খোঁজে সজাগ কড়া পাহারার ব্যবস্থা যে হয়েছে এটুকু নির্ভুলভাবে আপনাকে বলতে পারি।
পানামার বাজারের মধ্যে বাস করে গত কয়েকদিন যা সে জেনেছে, ফেলিপিলিও তারপর সানসেদোকে শুনিয়ে দেয়। কোতোয়ালির সিপাই সান্ত্রীদের তো বটেই, বাজারের সাধারণ লোকেদের মধ্যেও গানাদোর চেহারা চরিত্রের বর্ণনা কয়েকদিন। আগে তেঁড়া পিটে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে। সেই সঙ্গে ঘোষণা হয়েছে যে এই চেহারার মানুষের হদিস দিলে প্রচুর পুরস্কার মিলবে।
পুরস্কার দেবে বলে ঘোষণা করেছে? সব কথা শুনে সানসেদো বেশ একটু বিস্মিত সংশয়ের সুরে বলেন, কোনও ফেরারি গোলামের খোঁজ দেবার জন্যে সরকারি দপ্তর বা কোতোয়ালি থেকে পুরস্কার দিতে চায় এমন কথা তো কখনও শুনিনি। ফেরারি গোলাম হিসেবে গানাদোর দাম হঠাৎ এত বেড়ে গেল কী করে? জাহাজ থেকে তোমরা যেদিন নামো সেদিনও তো তার জন্যে এ খোঁজাখুঁজি ছিল না। পেরু থেকে এর মধ্যে আর কোনও জাহাজও আসেনি যে গানাদোর সেখানকার কীর্তি এখানে জানাজানি হয়ে তার খোঁজ এত জরুরি হয়ে পড়েছে। গানাদোর জন্যে পানামার সরকারের হঠাৎ এ পুরস্কার ঘোষণার মানেটা আমি ঠিক বুঝতে পারছি না।
আমি বাজারের নানা লোকের সঙ্গে আলাপ করে যা বুঝেছি, ফেলিপিলিও জানায়, তাতে পুরস্কারটা পানামার সরকারি দপ্তর কি কোতোয়ালি থেকে দেওয়া হচ্ছে বলে মনে হয় না। কোতোয়ালির মারফত ঘোষণাটা করা হলেও পুরস্কারটা দিতে চেয়েছে অন্য কেউ। শুনছি, মাত্র কদিন আগে স্পেন থেকে এখানে এসে কেউ একজন হন্যে হয়ে ঠিক গানাদোর মতো একজন গোলামকে খুঁজছে।
স্পেন থেকে এসে হন্যে হয়ে গানাদোকে খুঁজছে! সানসেদো নিজের মনেই যেন সরবে চিন্তা করেন—গানাদোর বিরুদ্ধে আক্রোশের যার সীমা নেই সে সোরাবিয়া তো এখনও পেরুতে। স্পেন থেকে গানাদোর এত বড় শত্রু আর কে আসতে পারে!
কথা বলতে বলতে বাজারের রাস্তা যেখানে বন্দরের দিকে মোড় নিয়েছে। সানসেদো আর ফেলিপিলিও সেখানে দাঁড়িয়ে পড়েছিলেন। হঠাৎ সে পথে একজনকে আসতে দেখে সানসেদো চমকে ওঠেন।
৩২. পানামা থেকে বার হওয়া
গানাদো আর কয়ার পানামা থেকে বার হওয়া বুঝি অসম্ভব!
বারবার ভাগ্যের অবিশ্বাস্য বিরোধিতা দেখে অন্তত তাই মনে হয়। তা না হলে একান্ত অনুকূল ঘটনা সম্পূর্ণ বিপরীত হয়ে দাঁড়ায় কেন।
জাহাজঘাটায় নামবার পর অচেনা দাস ব্যবসায়ীর হাতে না পড়ে কাপিতান সানসেদোর উপস্থিত বুদ্ধি ও তৎপরতায় রক্ষা পাওয়া আর তারপরে ডন মোরালেস-এর মতো উদার সহৃদয় মানুষের কাছে আশ্রয় পাওয়া আশাতীত সৌভাগ্য সন্দেহ নেই। কিন্তু সেই সৌভাগ্যই ডন মোরালেস-এর দেশ ও রাজভক্তির গোঁড়ামির দরুন অমন বিপজ্জনক হয়ে উঠবে আগে তো ভাবতে পারা যায়নি!
এটুকু বলা যায় যে, গানাদো এমন তেজি ও সাচ্চা কথার মানুষ না হলে সে বিপদ অবশ্য ঘটত না। মোরালেস-এর কাছে নিজের যথার্থ মনোভাব গোপন রাখলে তিনি পানামার নতুন শাসনকর্তাকে দিয়ে গানাদোর ক্রীতদাসত্বের কলঙ্কমোচনের ব্যবস্থা বোধহয় করতে পারতেন। কিন্তু আর যেভাবেই হোক অতখানি মিথ্যা পরিচয়ের মূল্যে নিজেদের মুক্তি কিনতে রাজি হওয়া গানাদোর পক্ষে সম্ভব নয়।