কাপিন সানসেদোর জ্বলন্ত কণ্ঠের ধিক্কার কিন্তু নিষ্ফলই হয়। কয়েক মুহূর্ত নীরব থেকে ডন মোরালেস আগেকার মতোই বিষণ্ণ গম্ভীর গলায় বলেন, আমায় মাপ করবেন, কাপিন, যুক্তিতর্ক বিচারে আমার মনের ভাব বদলাবার নয়। স্পেনের বিজয়-পতাকা সমুদ্র পারে দূরদূরান্তরে যারা মেলে ধরছে আমার চোখে তারা সব বিচারের ঊর্ধ্বে। তাদের উদ্দেশ্যে বাধা দেওয়া আমার কাছে। চরম রাজদ্রোহিতা। গানাদোকে তাই আমি ক্ষমা করতে পারব না। ওকে কাল সূর্যোদয়ের আগে আমার বাড়ি ছেড়ে যেতেই হবে।
আর যে মেয়েটি গানাদোর সঙ্গে এসেছে, তিক্ত শ্লেষ ও ক্ষোভের সঙ্গে জিজ্ঞাসা করেন কাপিন, তাকেও আর আপনি বাড়িতে স্থান দিতে চান না নিশ্চয়?
না, মোরালেস কাপিতানের আক্রমণে এবার একটু আহত স্বরেই বলেন, ওই অসহায় মেয়েটিকে আশ্রয় দিতে আমার কোনও আপত্তি নেই। কিন্তু গানাদো চলে যাবার পর ওর এখানে একলা থাকা বোধহয় সম্ভব নয়। ওর আশ্রয়ের সমস্যাটা তাই কঠিন। ও তো আমাদের ভাষাও জানে না।
কিছুটা জানি। তাই বলছি, আমার ভাবনা কাউকে ভাবতে হবে না। কারও ভার আমি হতে চাই না।
ঘরের সবাইকে চমকে দরজার দিকে তাকাতে হয়। সেখানে দাঁড়িয়ে মৃদু ঈষৎ বিকৃত উচ্চারণে হলেও দৃঢ়কণ্ঠে ও কথা যে বলেছে সে কয়া। কখন সে যে ওখানে এসে দাঁড়িয়েছে কেউ লক্ষ করেননি। সে যে দরজার পাশে এসে দাঁড়িয়ে তাঁদের। আলোচনা শুনতে পারে ও তা বোঝাবার মতো ক্ষমতা টমবেজ বন্দরে জাহাজে ওঠবার পর থেকে পানামায় এই কয়েক দিন থেকেই আয়ত্ত করে থাকতে পারে তা কল্পনাতেই আসেনি কারও। এমনকী গানাদোরও নয়। অবলা অসহায় একটি মেয়ে হিসেবে তাকে রক্ষা করার দায়িত্বটুকুই শুধু স্মরণ রেখে তার স্বাধীন সত্তার কথা যেন ভুলেই ছিলেন এ কয়দিন। আর যারই হোক, গানাদোর কিন্তু তা ভোলা উচিত হয়নি। পেরুর কুজকো আর সৌসায় সদ্য কৈশোর পার হওয়া যে মেয়েটি একলা সাহস ও বুদ্ধির অতবড় কঠিন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে আসতে পেরেছে, অজানা বিদেশে পা দেবার সঙ্গে সঙ্গে সে পরগাছা দুর্বল কোনও লতার মতো অক্ষম অসহায় হয়ে যাবে ভাবাই ভুল।
ওই ক্ষীণকায়া একটি মেয়ের সামনে সবাই কেমন একটু অপ্রস্তুত হয়ে পড়েন। সবচেয়ে লজ্জিত হন গানাদো নিজে। লজ্জিত আর দুঃখিতও।
তখনই উঠে পড়ে কয়ার কাছে গিয়ে তিনি দাঁড়ান। দাঁড়িয়ে অপরাধীর মতো বলেন, আমায় তুমি ভুল বুঝেছ, বুঝতে পারছি কয়া। এখান থেকে কেমন করে উদ্ধার পাব সেই দুর্ভাবনায় ক-দিন ধরে এত অস্থির হয়ে কাটাচ্ছি যে তোমার সঙ্গে দুটো কথা বলবারও সময় পাইনি। সেটা অবহেলা নয়, কয়া। তোমাকে শান্তিতে রাখবার জন্যেই আমার দুর্ভাবনার ভাগ তোমাকে দিতে চাইনি। কিন্তু সেইটেই আমার ভুল। নিরুপায় বোঝা হয়ে থাকবার মেয়ে যে তুমি নও সে কথা আমার মনে রাখা উচিত ছিল। জীবনে এ ভুল আর করব না। এখন তৈরি হয়ে নাও। ভাগ্যে যা-ই থাক, আজ রাত্রেই পানামা থেকে আমরা বার হব যোজকের পাহাড় ডিঙিয়ে ওপারের কোনও বন্দরে যাবার জন্যে।
তাহলে আমিও তোমাদের সঙ্গী হচ্ছি, জেনে রাখো। কাপিন সানসেদো দাঁড়িয়ে উঠে দৃঢ়স্বরে জানান, পথে যদি মারাও পড়ি, তাতে আমার দুঃখ নেই। এই পানামা আমার কবর যেন না হয়, এখন এই আমার একমাত্র কামনা।
কথাগুলো বলে ডন মোরালেস-এর বাড়িটাই যেন গোটা পানামা শহর এমনই ঘৃণাভরে সেদিকে তাকিয়ে সানসেদো বার হয়ে যাচ্ছিলেন। গানাদো তাঁকে ডেকে থামিয়ে বলেন, আজ রাত্রেই যখন আমরা রওনা হচ্ছি তখন শহরে ফেলিপিলিওর একটু খোঁজ করে আসবেন। এখান থেকে যাবার আগে তাকে একটু জানাতে চাই। ইচ্ছে করলে সে-ও আমাদের সঙ্গী হতে পারে। জাহাজঘাটায় আপনার কাছে অমনভাবে বিক্রি হয়ে যাবার পর আমাদের পরিণাম না জানতে পেরে সে অস্থির হয়ে আছে। তাকে পেতে খুব অসুবিধে বোধহয় হবে না। আমাদের খোঁজে বাজারের রাস্তাতেই সে ঘোরাঘুরি করবে বলে মনে হয়।
গানাদোর অনুমান ঠিক। কাপিন সানসেদো বাজারের রাস্তাতেই ফেলিপিলিওকে পেয়ে যান। কিন্তু তার পরে এমন আর-একজনের দেখা পান যাকে পানামা শহরে দেখবার কথা তাঁর কল্পনার বাইরে।
সানসেদো ফেলিপিলিওকে জাহাজঘাটায় মাত্র খানিকক্ষণের জন্য দেখেছিলেন। তার বিশেষ চেহারা পোশাকের জন্যে ছবিটা একটু যেন মনে ছিল। ফেলিপিলিও নিজেই তাঁকে ডেকে না কথা বললে শুধু তারই জোরে পানামা শহরে বাজারের ভিড়ে ফেলিপিলিওকে তিনি অবশ্য খুঁজে নিতে হয়তো পারতেন না।
ফেলিপিলিও সত্যিই কদিন ধরে অত্যন্ত যন্ত্রণার মধ্যে দিশাহারা হয়ে কাটিয়েছে। জাহাজঘাটায় গানাদো আর কয়াকে অজানা এক ব্যাপারী কিনে নেবার পর সে চোখে একেবারে আঁধার দেখেছে। বিক্রির ভান করতে বাধ্য হলেও কেনাবেচার পর ব্যাপারী কোথায় গানাদো আর কয়াকে নিয়ে যায় পিছু পিছু গিয়ে একবার দেখে আসার ইচ্ছে তার হয়েছিল। কিন্তু মুখের গ্রাস ফসকে যাবার দরুন অন্য যে দালাল তখনও জাহাজঘাটায় দাঁড়িয়ে গজরাচ্ছে তারই কড়া নজরের সামনে সে অনুসরণ আর সম্ভব হয়নি।
পানামা শহরে কী সে এর পর করবে তাই ঠিক করা তার পক্ষে কঠিন হয়ে উঠেছে। একটা সুবিধের কথা এই যে গানাদো আর কয়ার দাম হিসেবে বেশ কিছু নগদ পেসো দে অরো সে হাতে পেয়েছে। শেষ পর্যন্ত তারই জোরে পানামার বাজারের মধ্যে দেশি মানুষের পাড়ায় একটা আস্তানা জোগাড় করে নিতে তার অসুবিধে হয় না। মুশকিল হয় শুধু কোনও হদিস না জানা থাকায় গানাদো আর কয়ার খোঁজ করা। সত্যিকার গোলামের ব্যাপারীর কাছে তাঁরা যে বিক্রি হননি তা আর ফেলিপিলিও কোথা থেকে জানবে! ক্রীতদাস হিসেবে বাজারের রাস্তাতেই তাদের কোনও সময়ে আসা সম্ভব মনে করে সেইখানেই সে ব্যাকুলভাবে প্রতিদিন যতক্ষণ সম্ভব টহল দিয়ে বেড়ায়।