তার পর বিমূঢ় অবিশ্বাসের স্বরে যা জিজ্ঞেস করেন, পানামা বন্দরে জাহাজ ভেড়াবার পর গানাদো আর কয়া অমন নাটকীয় ভাবে গোলামের কারবারির এক দালালের কাছে বিক্রি হয়ে যাবার রহস্য তাতেই কিছুটা পরিষ্কার হয়ে যায় বোধহয়।
এ কী ব্যাপার, কাপিন!ডন মোরালেস-এর কণ্ঠ বিমূঢ় বিস্ময়ে তীক্ষ্ণ হয়ে ওঠে, আপনি এ দুই গোলাম বাঁদি পেলেন কোথায়?
কোথায় আবার! কাপিতান বলে ডন মোরালেস যাঁকে সম্বোধন করেছেন সেই সৌম্য-দর্শন প্রৌঢ় একটু হেসে বলেন, জাহাজঘাটা থেকে কিনে নিয়ে এলাম!
কিনে নিয়ে এলেন! ডন মোরালেস কথাটা বিশ্বাস করতে পারেন না—আপনি সাত সকালে জাহাজঘাটায় গেছলেন গোলাম বাঁদি কিনতে?
এ কারবারে দাঁও মারতে হলে তা-ই তো যেতে হয়। কাপিন গলায় পরিহাসের সুরটা স্পষ্ট করে তুলে বাহাদুরির ভান করে বলেন, কী রকম সরেস মাল বাগিয়েছি একবার ভাল করে নজর দিয়েই দেখুন না!
ডন মোরালেস তাই দেখেন এবার। আর দেখার সঙ্গে তাঁর দৃষ্টি সত্যিই বিস্ফারিত হয়ে ওঠে।
গানাদোর দিকে চেয়ে তাঁর কণ্ঠে একটা বিস্ময়-ধ্বনিই শুধু শোনা যায়, এ কী! এ তো—
হ্যাঁ, ডন মোরালেস, কাপিন হাসিমুখে তাঁর অসমাপ্ত কথাটা পূরণ করে দিয়ে বলেন, এ ক্রীতদাস আপনার অচেনা নয়। একদিন আপনিই তাকে আশ্রয় দিয়েছিলেন। আজ আপনার কাছেই তাই ওদের নিয়ে এলাম।
পানামার বন্দরে জাহাজ ভিড়বার পর কোনও ক্রীতদাসের ব্যাপারীর হাতে পড়বার ভয় ছিল গানাদোর মনে। যা ভয় করেছিলেন, হয়েছিলও তাই। জাহাজঘাটার জব্বর এক ব্যাপারীর দালালের নজর পড়েছিল তাঁর আর কয়ার ওপর। আগে থাকতে তাক করলেও শেষ পর্যন্ত শিকার অবশ্য তার হাত থেকে ফসূকে গেছে। তার ওপরে টেক্কা দিয়ে আর-এক গোলাম কেনা-বেচার কারবারি গানাদো আর কয়াকে নগদা দামে কিনে নিয়েছে।
গানাদো আর কয়ার পক্ষে এ পরিণামটা তপ্ত খোলা থেকে গনগনে চুলোয় পড়ার শামিল হওয়ারই কথা। কিন্তু তা হয়নি।
না হবার কারণ এই যে জাহাজঘাটায় চড়া নগদ দাম দিয়ে যিনি গোলাম হিসেবে কয়া আর গানাদোকে কিনে নিয়েছেন তিনি আর কেউ নন, গানাদোর বন্ধু ও গুরুজনস্থানীয় পরম হিতৈষী সেই কাপিন সানসেদো।
কাপিন সানসেদো অবশ্য কস্মিনকালে গোলাম বাঁদি কেনাবেচার কারবারি নন। শুধু অবস্থা গতিকে গানাদোকে রক্ষা করবার জন্যে তাঁকে তা-ই সাজতে হয়েছে।
কিন্তু অত সকালে এই বিশেষ দিনটিতে জাহাজঘাটায় তাঁর হাজির হওয়াটাই একটু আশ্চর্য ব্যাপার নয় কি?
না, তাও নয়। কারণ পেরু-ফেরতা যে কোনও জাহাজ পানামা বন্দরে ভিড়লেই তা দেখতে যাওয়া কাপিন সানসেদোর অবশ্য কর্তব্য হয়ে দাঁড়িয়েছে বহুকাল ধরে। পেরুর উপকূল থেকে কোনও জাহাজ ফিরছে জানলে একবার বন্দরটা তিনি ঘুরে যাবেনই।
এ ঘোরাঘুরি যে গানাদোর জন্যে তা বলা বাহুল্য। যে সান্তা মার্তা দ্বীপে পিজারোর পেরু অভিযানের সংকল্পের প্রায় সমাধি হতে চলেছিল, সেখান থেকে কৌশলে। অভিযাত্রীদের সকলকে সরাবার ব্যবস্থা করে গানাদো কাপিন সানসেদোকে নিয়ে মাঝখানের পাহাড় ডিঙিয়ে পানামায় গিয়ে পৌঁছোবার পর সেবারকার মতো পিজারোর অভিযানের আর সঙ্গী হতে পারেননি। পরে ভিন্ন পরিচয় নিয়ে অন্য একটি দলের সঙ্গে পুনা দ্বীপে গিয়ে তিনি পিজারোর বাহিনীর সঙ্গে যোগ দেন। স্বাস্থ্যে শক্তিতে কুলোবে না বলে প্রৌঢ় কাপিন সানসেদোকে অনিচ্ছা সত্ত্বেও তখন থেকে পানামাতেই থেকে যেতে হয়। গানাদোরই গোপন নির্দেশে কাপিন সানসেদো ইতিমধ্যে ডন মোরালেস-এর সঙ্গে ভাব করে তাঁরই অতিথি হয়ে আছেন। মোরালেস-এরই এক কালের ক্রীতদাস গানাদো সম্বন্ধে সানসেদো অবশ্য কোনও কথা এ পর্যন্ত ভাঙেননি। পেরু-ফেরতা জাহাজের খোঁজ নিতে তাঁর পানামার বন্দরে যাওয়ার বাতিকটাও যথাসম্ভব গোপন রেখেছেন ডন মোরালেস-এর কাছে। এ বাতিক সত্যিই একদিন এতখানি কাজে লাগবে তা সানসেদো নিজেই ভাবতে পারেননি।
এইবার অবশ্য ডন মোরালেসকে সমস্ত কথাই খুলে বলতে হয়।
মোরালেস সত্যিই উদার সহৃদয় মানুষ। এক কালে ক্রীতদাস হিসেবে যাকে দেখেছেন, সত্যকার পরিচয় জানবার পর সেই গানাদোকে যথাযোগ্য মর্যাদা দিতে তাঁর বাধে না। গানাদো আর কয়ার আশু আশ্রয়ের সমস্যা সহজেই তাই মিটে যায়। মোরালেস-এর আস্তানায় তাঁরা যতদিন খুশি থাকতে পারেন।
কিন্তু আশ্রয়ের সমস্যা এভাবে মিটিয়ে তো গানাদো খুশি হতে পারেন না। মোরালেস-এর বাড়িতে কয়াকে নিয়ে সসম্মানেই তিনি ঠাঁই পেয়েছেন, কিন্তু এখানে থাকা মানে তো সমস্ত পানামা শহরের কাছে গা ঢাকা দিয়ে চোরের মতো লুকিয়ে থাকা। ক্রীতদাস কেনাবেচার কারবার ফলাও ভাবে শুরু হবার পর থেকে পানামা শহরেও কোতোয়ালদের হুঁশিয়ারি আর আইন কানুনের কড়াকড়ি বেড়ে গিয়েছে। গোলামদের সম্বন্ধে আগেকার সে ঢিলে-ঢালা উদাসীন মনোভাব আর নেই। ফেরারি গোলাম হিসেবে গানাদো এখানকার দাগি আসামি। একবার তিনি এ শহরের পাহারা এড়িয়ে বেমালুম গা-ঢাকা দিতে পেরেছিলেন বটে, কিন্তু এখন আর তা কি সম্ভব? যে ব্যাপারীর দালাল তাঁর সঙ্গে কয়াকে কিনতে চেয়েছিল সে-ও এখন তাঁদের শত্রু। কোতয়ালির লোকজনের তো বটেই, শহরে সে দালালের কড়া নজরে পড়বার সম্ভাবনাও কম নয়। নিজে একা হলে খুব বেশি ভাবনা গানাদোর ছিল না। কিন্তু সঙ্গে কয়া থাকাতেই সমস্যা অত কঠিন হয়ে উঠেছে।