শেষ কথাটা বলা হয়েছে পাশের আর একটি প্রৌঢ়-গোছের লোককে। এ লোকটিও ওই জায়গা দিয়ে যেতে যেতে প্রথম দালালের ক্রুদ্ধ চিৎকার শুনেই বোধহয় দাঁড়িয়ে পড়েছে।
চেহারায় সৌম্য শান্ত গোছের মনে হলেও এ লোকটিও যে আর-এক দালাল তা বোঝা গেছে দু-একটি কথার পরেই।
প্রথম দালালের প্রশ্নের উত্তরে প্রৌঢ় লোকটি বেশ তিক্ত স্বরেই বলেছে, হ্যাঁ, দেখলাম। দেখেই তো দাঁড়িয়ে পড়েছি।
আমি এখানেই ওর ছাল চামড়া ছাড়িয়ে নিচ্ছি, দেখুন না। গর্জন করে বলেছে প্রথম দালাল।
না। দৃঢ় স্বরে আপত্তি জানিয়েছে প্রৌঢ় লোকটি, ছাল ছাড়াবার সুখটা আমিই করতে চাই।
তার মানে? বিস্ময়ের সঙ্গে বিরক্তিও একটু ফুটে উঠেছে প্রথম দালালের স্বরে।
তার মানে ওর তেজ দেখে আমিই কিনে নেব ঠিক করেছি, জোরালো গলায় জানিয়েছে প্রৌঢ় লোকটি।
আপনি কিনে নেবেন? এবার ব্যঙ্গের হাসি হেসে উঠেছে প্রথম দালাল আপনি কি গোলাম কেনা-বেচার কারবারী নাকি?
না, কারবারি নয়। প্রৌঢ় লোকটি স্বীকার করেছে এবার, আমি আপনারই মতো ব্যাপারীর দালাল।
ও, আপনি দালাল! প্রথম দালালের গায়ের জ্বালাটা এবার প্রকাশ পেয়েছে প্রৌঢ় লোকটির বিরুদ্ধে। কয়া আর গানাদোর দিকে আঙুল দেখিয়ে সে তীব্র অবজ্ঞার স্বরে বলেছে, কিন্তু আমি যে এই দুটোর জন্যে দাদন দিচ্ছি এখুনি।
দাদন দিচ্ছেন!—প্রৌঢ় দ্বিতীয় দালালের মেজাজও এবার চড়তে দেখা গিয়েছে—আর আমি যে পুরো দামে কিনে নিচ্ছি এখানেই এখনই।
বেশ কিনুন দেখি, কত আপনার মুরোদ! উপহাস করে বলেছে প্রথম দালাল, কত দাম এ দুটোর জন্যে দেবেন শুনি?
যা আপনি দেবেন তার চেয়ে দশ পেসো দে আরো বেশি! এবার গম্ভীর গলায় বলেছে দ্বিতীয় দালাল।
যা বলেছে করেছেও তা-ই। বন্দরের ওপর মুখরোচক ঝগড়ার গন্ধে গন্ধে তখন চারিদিকে বেশ একটু ভিড় জমে গেছে। তাদের সকলের সামনে প্রথম দালালের চেয়ে সত্যিই দশ পেসো দে অরো বেশি দাম ধরে দিয়েছে দ্বিতীয় দালাল।
পানামার বন্দরে পা দিতে-না-দিতে ফেলিপিলিওর বিমূঢ়-বিহ্বল অসহায় দৃষ্টির সামনে গানাদো কয়ার সঙ্গে বিক্রি হয়ে গেছেন ক্রীতদাসের ব্যাপারীর এক দালালের কাছে।
বিক্রি হয়ে যাবার পর গোরু-ছাগলের মতোই গানাদো আর কয়াকে নতুন মালিকের সঙ্গে বন্দর ছেড়ে যেতে হয়।
পানামা শহর তখন জমজমাট হয়ে উঠেছে শুধু পেরু আবিষ্কারের দৌলতেই।
সেখানকার লুঠ করা ঐশ্বর্য এই পানামা হয়েই স্পেনে চালান যায়, আর সে লুঠের ছিটেফোঁটা বখরাতেই কেঁপে ওঠে পানামা শহর। জমজমাট বলতে অবশ্য রাস্তা বাড়ি-ঘরের ছড়াছড়ি কি শোভা-সৌন্দর্য ভাবলে ভুল হবে। আসলে জংলা জলা বাদার দেশ। সেখানে মানুষের ভিড় বেড়ে শহর ভাল করে ছড়াতে না পেরে ঘিঞ্জিই হয়েছে আরও বেশি।
সেই ঘিঞ্জি ভুঁইফোড় শহরের রাস্তা দিয়ে গোলাম হিসেবে তাঁদের যে কিনেছে সেই ব্যাপারীর দালাল গানাদো আর কয়াকে হাঁটিয়ে নিয়ে যায়।
তার সঙ্গে ঘোড়া আছে। নিজে সে ইচ্ছে করলে তাতে চেপে যেতে পারত। কিন্তু তার বদলে ঘোড়ার লাগাম ধরে সে তার নতুন কেনা ক্রীতদাস-ক্রীতদাসীর সঙ্গে হেঁটেই চলে। নতুন গোলাম আর বাঁদি যাতে পালাতে না পারে সেইজন্যেই কি এই সাবধানতা?
তা হবে বোধহয়! পথে যেতে যেতে যেভাবে ব্যাপারী তাদের দিকে মাঝে মাঝে চেয়ে দেখে তাতে বেশ বড় গোছের দাঁও সে মেরেছে বলেই মনে হয়।
তখন সবে সকাল হয়েছে। পানামার রাস্তায় কিন্তু লোকজনের অভাব নেই। দু-চারজন তার মধ্যে নাম না জানুক, ব্যাপারীর মুখ বোধহয় চেনে। তারা একটু সবিস্ময়েই তার হাতে ধরা দড়িতে বাঁধা গোলাম আর বাঁদিকে লক্ষ করে।
পানামা শহরের রাস্তায় হাতে দড়ি বাঁধা বাঁদি-বান্দাকে নিয়ে যেতে দেখা এমন কিছু অদ্ভুত ব্যাপার নয়! ব্যাপারটা প্রায় নিত্য-নৈমিত্তিক। গানাদো আর কয়ার বেলা এই বিশেষ বিস্মিত কৌতূহল তাই একটু অস্বাভাবিক।
গানাদোকে কেউ কেউ চিনতে পারে বলেই কি এই বিস্মিত কৌতূহল ফুটে ওঠে তাদের মুখে?
না, তা নয়। কয়া এ শহরে সম্পূর্ণ অচেনা তো বটেই, কিছুকাল এ শহরে কাটিয়ে যাওয়া সত্ত্বেও গানাদোকে চেনবার মতো মানুষও পানামা শহরে তখন নেই বললেই হয়। পানামা তখন তো শেকড় মেলবার শহর নয়, ভেসে যেতে যেতে দু-দণ্ড ঠেকে যাবার আঘাটা মাত্র। পুরনো মহাদেশ থেকে ভাগ্য ফেরাতে কি সেখানকার অপরাধের সাজা এড়াতে যারা এখানে এসে ঠেকে তারা স্রোতের শেওলার মতো। দু-চার দিন কি বড় জোর দু-এক বছরের বেশি কেউ বড় একটা এখানে আটকে থাকে না। নতুন ধান্দায় অথবা হুজুগের ঢেউ-এ অন্য কোথাও ভেসে যায়। পানামা শহরে তখন যারা আছে গোনা-গুনতি দু-একজন বাদে সবাই তারা একেবারে নতুন লোক।
গানাদোকে তারা কেউ চেনে না।
তুচ্ছ অজানা গোলাম বাঁদিকে নয়, অবাক দু-একজন হয় তাদের মালিককে দেখে।
অবাক হল ডন মোরালেসও।
হ্যাঁ, সেই ডন মোরালেস, একদিন যাঁর বাড়িতে পিজারো আর তাঁর বন্ধু আলমাগরোর নিত্য বৈঠক বসেছে সূর্য কাঁদলে সোনার দেশে অভিযানের উপায় ভাবতে।
পানামা শহরের প্রথম পত্তনের সময়কার বাসিন্দাদের মধ্যে তিনিই আর দু-একজনের মতো এখনও পর্যন্ত টিকে আছেন।
কী কাজে ডন মোরালেস সবে বুঝি বাড়ি ছেড়ে বেরিয়েছিলেন।
তাঁর বাড়ির রাস্তায় হাতে দড়ি বাঁধা দু-জন গোলাম বাঁদি আর তাদের মালিককে আসতে দেখে তিনি অবাক হয়ে থমকে দাঁড়িয়ে পড়েন।