এই সূত্রে নিজের অভিজ্ঞতার কথা বলতে গিয়ে এই সমুদ্রপথেরই আগেকার একটি দুর্ভেদ্য রহস্যের তিনি নিজে থেকেই মীমাংসা করে দিয়েছিলেন।
এই অজানা পশ্চিম মহাসাগরে নাখোদা বার্থলোমিউ রুইজ দ্বিতীয় বার পিজারোর অভিযানের নৌ-সেনাপতি হয়ে এসে এ দেশের অদ্ভুত পালতোলা সমুদ্রযাত্রী ভেলা থেকে দোভাষী হিসেবে একটি লোককে নিজের জাহাজে তুলে নেন। টম্বেজ বন্দরে ঘুরে পিজারো যে দ্বীপে ছিলেন সেখানে জাহাজ ভেড়াবার পর সেই দোভাষী আশ্চর্যভাবে হঠাৎ নিখোঁজ হয়ে যায়।
নিখোঁজ হবার কৌশলটা এবার প্রকাশ করে দিয়েছিলেন গানাদো। তিনি জাহাজ থেকে কোথাও পালিয়ে যাননি। কেউ তাঁর খোঁজ না পেলেও তিনি জাহাজের ভেতরেই ছিলেন। ছিলেন মরণাপন্ন রোগী সেজে মৃত একজন সৈনিকেরই বিছানায়। তখনকার দিনে জাহাজে অসুস্থ না হলে কেউ বিছানা নিত না, আর বিছানা নিলে তা থেকে ওঠবার আশা কেউ করত না। কারণ রোগীদের শুশ্রুষার কি চিকিৎসার কোনও ব্যবস্থাই ছিল না জাহাজে।
পিজারোকে যে দ্বীপ থেকে রুইজ তুলে নিতে গিয়েছিলেন সেখানে জাহাজ ভেড়াবার সময় দু-জন নাবিক রুইজের জাহাজে অসুস্থ হয়ে পড়েছিল। নিজে থেকে তাদের একটু দেখাশোনা করতে গিয়ে গানাদো একজনকে মৃত অবস্থায় দেখেন! তাই থেকেই সম্পূর্ণভাবে আত্মগোপন করে পানামায় নামার উপায়টা তাঁর মাথায় আসে।
অন্য নাবিকেরা যখন দ্বীপে নেমে আমোদ আহ্লাদে ব্যস্ত সেই সময়ে জাহাজে উঠে এসে গানাদো মৃত সৈনিকটির যথাযযাগ্য সমুদ্র সৎকারের ব্যবস্থা করেন। তারপর তার রোগশয্যাই গানাদোর জন্যে সন্ধানের অসাধ্য গোপন আশ্রয় হয়ে ওঠে। রোগী হিসেবে তাঁর দিকে কেউ একবার দৃষ্টিপাতও করেনি। নেহাত দয়া করে কখনও একটু পান করার জল বা সামান্য কিছু খাদ্য কেউ কখনও রেখে গেছে। সেই ভাবেই সেবার পানামা পর্যন্ত পৌঁছে তিনি সুযোগ বুঝে জাহাজ থেকে সকলের অগোচরে এক সময়ে উধাও হয়ে গিয়েছিলেন। হঠাৎ অদৃশ্য হওয়া দোভাষী সম্বন্ধে খোঁজ হয়েছে, কিন্তু একটা মুমূর্ষ রোগীর অন্তর্ধান নিয়ে কেউ মাথা ঘামায়নি।
একা হলে, আর সুযোগ থাকলে এবারেও সেইরকম রোগী সেজে সকলের চোখের আড়ালে থাকার ব্যবস্থাই পছন্দ করতেন গানাদো। সে সুযোগ হয়তো হতে পারত, কিন্তু সঙ্গে কয়া আছে। তাকে নিরাপদ রাখবার জন্যেই তার সঙ্গে থাকা একান্ত প্রয়োজন। পাখির মতো হৃদয় যার কোমল, পাশে থেকে সাহস না দিলে এই অবিশ্বাস্য অমানুষিক পরিবেশে ভয়ে হতাশাতেই সে নিশ্চয় মারা পড়ত।
জাহাজে যতক্ষণ আছেন ততক্ষণ অবশ্য কোনও ভয় নেই। গোরু-ছাগলের মতো ক্রীতদাসদের যেখানে প্রায় খাঁচাবন্দি করে রাখা হয় সেখানে তাদের দিকে দৃষ্টি দেবার উৎসাহ কারও হয় না।
বিপদ জাহাজ থেকে ক্রীতদাস হিসেবে নামবার পর। পানামার বন্দরে আগে থাকতে বাছাই করে চিহ্নিত করে রাখবার জন্যে ক্রীতদাসের ব্যাপারীদের দালালরা জাহাজ ভিড়তেনা-ভিড়তে এসে হাজির থাকে।
খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে সব ক্রীতদাসের চেহারা তাকত যাচাই করে দেখাই তাদের পেশা। তারা নেহাত বুড়ো হাবড়া বা রুগ্ন না হলে অবহেলাভরে কাউকে বাদ দেয় না। একবার তাদের নজর পড়ে গেলে আর নিস্তার নেই।
দাদন দিয়ে তারা বাছাই করা গোলামকে তখনই অর্ধেক কিনে রাখতে পারে। জাহাজে করে ক্রীতদাস-দাসী যে আনে তারও তখন সাধ্য নেই সে দাদন নিতে অস্বীকার করে। ইচ্ছা করলে ব্যাপারী বা তার দালাল দাদন না দিয়ে পুরো দামে গোলামকে কিনেও নিতে পারে।
তিনি নিজে না হলেও পানামার যাত্রী জাহাজ পৌঁছোবার পর কয়া এমনই কোনও দালালের চোখে ধরে যেতে পারে এই ছিল গানাদোর সব চেয়ে বড় ভয়।
৩১. বন্দরে জাহাজ লাগাবার পর
বন্দরে জাহাজ লাগাবার পর যা ভয় করেছিলেন হয়েছেও ঠিক তা-ই।
নতুন জয় করা সূর্য কাঁদলে সোনার দেশ থেকে জাহাজ এসে পানামার বন্দরে লাগলে অনেকেই সেখানে গিয়ে হাজির হয়। কেউ যায় পরিচিত বন্ধুবান্ধব আসছে জেনে, কেউ-বা শুধু সে দেশের নতুন খবরাখবর জানবার কৌতূহলে। পানামার রাজসরকার থেকে খাজাঞ্চি কোতোয়াল যায় স্পেনের সম্রাটের জন্যে পাঠানো সোনাদানার দখল নিতে আর আসে ব্যাপারী বা তাদের দালারেরা ভিকুনার পশম কি আলপাকার রেশমি লোমে বোনা কাপড়-চোপড়ের মতো সওদা থেকে কেনাবেচার গোলামের মতো পণ্যের খোঁজে।
ফেলিপিলিও ক্রীতদাস হিসেবে গানাদো আর কয়াকে নিয়ে বন্দরে পা দিতে-না-দিতেই একজন নয়, দু-জন দালালের চোখে পড়েছে।
কয়ার মুখ আর শরীর প্রায় আগাগোড়াই বেটপ নোংরা ময়লা পোশাকে ঢাকা। কিন্তু তা সত্ত্বেও পাশ দিয়ে চলে যেতে গিয়ে একজন থমকে দাঁড়িয়ে পড়েছে হঠাৎ।
তারপর বর্বর তাচ্ছিল্যের সঙ্গে টান দিতে গেছে কয়ার গায়ের কাপড়ে।
ফেলিপিলিও বাধা দিতে গেছে, কিন্তু তার আগেই গানাদো এক ঝটকায় দালালের হাতটা সরিয়ে দিয়ে কয়াকে আড়াল করে দাঁড়িয়েছেন।
প্রথমে সত্যিই হতভম্ব হয়ে গেছে দালাল। তারপর তার দু-চোখ দিয়ে আগুন ঠিকরে বেরিয়েছে। একটা ক্রীতদাসের এরকম স্পর্ধা দালালের বুঝি কল্পনারও বাইরে।
দাঁতে দাঁত ঘষে হিংস্র জ্বলন্ত স্বরে সে ফেলিপিলিওকেই প্রথম গালাগাল দিয়ে বলেছেন, তুমি এ গোলামের মালিক! গোলাম হয়ে সে ভদ্রলোকের গায়ে হাত তোলে! ওর ওই হাত দুটো কেটে সমস্ত গায়ের ছাল ছাড়িয়ে নেব আর তোমারও গোলাম কেনাবেচার কারবার কেমন করে চলে তা দেখব! দেখেছেন সেনর এ গোলামের স্পর্ধা?