সমতলের সমুদ্রতীরের দিকে আকস্মিক জনবন্যার এ ব্যাখ্যা পেয়ে পিজারো সন্তুষ্ট হতে পারেননি। তিনি উদ্বিগ্ন ও বেশ একটু শঙ্কিতই হয়েছেন। সোরাবিয়া ও হেরাদার কাছে হুয়াসকার-এর হত্যার খবর তখন তিনি পেয়েছেন। হঠাৎ এ হত্যার। কারণ কী হতে পারে তিনি ভেবে পাননি। পরামর্শ সভা ডেকেও তিনি বিফল হয়েছেন। নানাজনের কাছে সব কটি আকস্মিক ব্যাপারের নানা ব্যাখ্যা পাওয়া গেছে। ঘটনাগুলির মধ্যে এ রাজ্যের নতুন কোনও অভ্যুত্থানের গভীর ষড়যন্ত্র আছে বলে সন্দেহ করেছে কেউ কেউ। পিজারোর নিজেরও সেরকম একটু সন্দেহ যে হয়নি এমন নয়। কিন্তু হুয়াসকার-এর অপ্রত্যাশিত হত্যার সঙ্গে অভিশপ্ত বলে দেশ ছেড়ে পালাবার এ উন্মত্ততার সম্পর্ক কী হতে পারে? রেইমির উৎসব পণ্ড হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে এ অভিশাপের আতঙ্ক কি আপনা থেকেই এ দেশের মানুষের মনে এমন দারুণ ও তীব্র হয়ে উঠেছে?
তা বোধহয় হয়নি।
ভাল করে খোঁজ নিলে পিজারো জানতে পারতেন যে অভিশাপের যে আতঙ্ক দিশাহারা ভয়োন্মত্ত পেরুবাসীর এ ঢল সাগরতীরের দিকে নামিয়েছে তার প্রথম উদ্ভব বেশ একটু রহস্যময়।
কুজকো শহরে রেইমি উৎসব অনুষ্ঠান পণ্ড হয়েছে। কিন্তু এ আতঙ্কের ঢেউ সেখান থেকে তো ওঠেনি। উঠেছে হঠাৎ কুজকো থেকে কামালকা নামবার পথে মাঝ রাস্তায়।
কুজকোয় হুয়াইনা কাপাক-এর প্রেত-প্রাসাদের ধার থেকে চুরি করে-আনা ঘোড়া দুটো যেখানে পাওয়া গেছে তার কাছাকাছি থেকেই যে অভিশাপের আতঙ্কটা প্রথম জাগতে শুরু করেছে এটুকু অন্তত সোরাবিয়া ও হেরাদারও খেয়াল করা উচিত ছিল।
ওই অঞ্চলের সকলকে ভয়ে দেশছাড়া করবার মতো ঘটনাটা হঠাৎ ওইখানেই কেন প্রথম শোনা গেছে তা বোধহয় তাহলে সোরাবিয়ার পক্ষে আঁচ করা খুব কঠিন হত না।
সোরাবিয়ার সে খেয়াল কিন্তু হয়নি। আতঙ্কবিহ্বল জনস্রোতের দরুন গানাদোকে ধরার এত বড় সুযোগটা তার নষ্ট হয়েছে এইটিই তার মনের জ্বালা। সে স্রোত-সৃষ্টিতে যে গানাদোর হাত থাকতে পারে তা সোরাবিয়া কল্পনাই করেনি।
হ্যাঁ, সমস্ত ব্যাপারটার মূলে গানাদোই আছেন। সোরাবিয়ার হিংস্র অনুসরণকে ব্যর্থ করার এই কৌশলই তাঁর হঠাৎ মাথায় এসেছে। এসেছে পাহাড়ের চূড়া থেকে অমোঘ নিয়তির মতো সওয়ার বাহিনীকে আসতে দেখার পর কয়ার কাছে। নিজেদের নিরুপায় অবস্থাটা বুঝিয়ে বলবার সময়।
নির্জন পার্বত্য পথে তাঁরা ছাড়া আর কোনও রাহি নেই বলেই সোরাবিয়ার দলের পক্ষে তাঁদের ধরে ফেলা অনিবার্য, তিনি হতাশভাবে বোঝাচ্ছিলেন। সেই হতাশার অন্ধকারে হঠাৎ নিজের যুক্তি থেকেই আশার আলো তিনি দেখতে পান।
পার্বত্য পথ নির্জন বলেই তাঁদের ধরা পড়া অবশ্যম্ভাবী। কিন্তু এ পথে যদি হঠাৎ জনস্রোত বইতে শুরু করে?
এ অঘটন ঘটাবার উপায় কিন্তু শেষ পর্যন্ত ভেবে বার করেছেন গানাদো। এসপানিওল বাহিনী তখনও কমপক্ষে একবেলার পথ পিছিয়ে আছে। গানাদো তাঁদের ঘোড়া দুটিকে সেখানেই ছেড়ে দিয়ে কাছাকাছি প্রথম যে গ্রামাঞ্চল পেয়েছেন। সেখানেই চলে গেছেন সাধারণ পেরুবাসীর সাজে।
তাঁর নিজের ও ফেলিপিলিওর দুজনের চেহারা পোশাক ঠিক গ্রামাঞ্চলের মানুষের মতো নয়। কিন্তু তাতে অসুবিধের বদলে সুবিধেই হয়েছে। কুজকোর সমৃদ্ধ সম্ভ্রান্ত ঘর থেকেই যেন তাঁরা আসছেন এইভাবে গানাদো গ্রামের মানুষের মধ্যে রেইমির উৎসব পণ্ড হওয়া ও হুয়াসকার-এর হত্যার ঘটনা বাড়িয়ে সমস্ত দেশ অভিশপ্ত হওয়ার রটনা শুরু করেছেন।
বিদেশি এসপানিওলরা এ পুণ্যভূমি তাদের পাপস্পর্শে অপবিত্র করার পর থেকে যা যা ঘটেছে তাতে দেশের মানুষের মন এমনিতেই দাহ্য হয়ে ছিল—রেইমি উৎসব পণ্ড হওয়ার সংবাদের সঙ্গে জড়িত হয়ে কুপিত সূর্যদেবের অভিশাপ সম্বন্ধে রটনায় তা দাউ দাউ করে জ্বলে উঠে চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়েছে।
আর্ত দিশাহারা মানুষের যে বন্যাস্রোত তারপর পাহাড়ের পথ দিয়ে নেমে গেছে। তার মধ্যে গানাদোর ফেলিপিলিও আর কয়ার সঙ্গে সম্পূর্ণ নিশ্চিহ্ন হয়ে নিজেদের মিশিয়ে দিতে কোনও অসুবিধাই হয়নি।
কাক্সামালকা পর্যন্ত তো বটেই, সেখান থেকে টম্বেজ বন্দর অবধি পাচাকামাক-এর মন্দিরে ধরনা দিতে যাওয়া ব্যাকুল অস্থির তীর্থযাত্রীদের মধ্যে তাঁরা বেমালুম গা-ঢাকা দিয়ে থেকেছেন।
টম্বেজ বন্দরে একটু বিপদ হতে পারত। কিন্তু গানাদো আর তার সঙ্গীদের পালাবার কৌশলটা তখনও সম্পূর্ণ অজ্ঞাত। কামালকা ছেড়ে যাবার পর পাচাকামাকের মন্দিরের পথে ভীত অস্থির যাত্রীদের ওপর তেমন নজর রাখা হয়নি। টম্বেজ বন্দরে কোনও পাহারাও ছিল না।
থাকলেও একটি মেয়ে আর একটি পুরুষ গোলাম নিয়ে পানামায় বেচতে যেতে কেউ বাধা পেত না বোধহয়। এরকম ক্রীতদাস ক্রীতদাসী তখন প্রতি জাহাজেই চালান হতে শুরু করেছে।
টম্বেজ বন্দরের একটি জাহাজে এমনই এক ব্যবসায়ীর সঙ্গে এক জোড়া দাস-দাসী দেখা গেছল।
কে এই ব্যবসাদার?
না, গানাদো নয়। এই ভূমিকাটা ফেলিপিলিওর ওপর চাপিয়ে দিয়ে, গানাদো কয়া-র সঙ্গে গোরু ঘোড়ার মতো বেচাকেনার গোলামই সেজেছেন।
ফেলিপিলিও তাতে আপত্তি করেছিল প্রবলভাবে। কিন্তু গানাদো হেসে তাকে বুঝিয়েছিলেন যে ফেলিপিলিও নিজে যাতে অনভ্যস্ত সেই ক্রীতদাসের ভূমিকাটা তাঁর কাছে নতুন নয়। এ ভূমিকায় তিনি পাকা, তাই তার দুঃখ কষ্ট যন্ত্রণার সঙ্গে ভালরকম পরিচয়ই তাঁর আছে।