ম্লান একটু হেসে সেই কথাই বলেছে কয়া, সত্যি, কোথায় ধরা দেব, এখানে, না আরও দূরে কোথাও, শুধু এইটুকুই এখন আমরা বেছে নিতে পারি।
হ্যাঁ—গানাদোর স্বর এই প্রথম যেন বড় বেশি ক্লান্ত শুনিয়েছে—আমাদের ধরে ফেলতে ওদের খুব কষ্টও করতে হবে না। কারণ পথ এই একটাই, আর আমরা বাদে তাতে আর কোনও যাত্রীও নেই।
কথাগুলো বলতে বলতে গানাদোর চোখে হঠাৎ যে ঝিলিকটা দেখা গেছে সেটা কি অমোঘ নিয়তির বিরুদ্ধে অসহায় নিষ্ফল আক্রোশের?
৩০. হেরাদা ও সোরাবিয়ার তাড়নায়
হেরাদা ও সোরাবিয়ার তাড়নায় তাদের সওয়ার দল অনুসরণে ঢিলে দেয়নি। অক্লান্তভাবে চালিয়ে যথাসময়ের আগেই তারা কাক্সামালকায় পৌঁছেছে।
কিন্তু কোথায় তাদের শিকার?
গানাদো ফেলিপিলিও কি কয়া কারও সন্ধানই তারা পায়নি। পেয়েছে অবশ্য তাদের ঘোড়া দুটোর। পাহাড়ি সড়কের এক জায়গায় একটা অত্যন্ত খাড়াই পায়ে-হাঁটা পথের ধারের ছোট একটা কয়েক ঘর বসতির গাঁয়ের সামনে ঘোড়া দুটো ছাড়া অবস্থায় পাওয়া গেছে।
কখন কারা ঘোড়া দুটোকে অমন জায়গায় ছেড়ে গেছে তার কোনও হদিস মেলেনি। হদিস দেবে কে? গাঁয়ে একটা মানুষ আছে যে তার কাছে খোঁজ মিলবে।
কোথায় গেল গাঁয়ের মানুষ? একটা নয়, দুটো নয়, পর পর কয়েকটা এমনই খাঁ-খাঁ গাঁ আর বসতি পার হওয়ার পর গাঁয়ে মানুষ না থাকার মানেটা বোঝা গেছে।
গাঁয়ে মানুষ পাওয়া যাবে কেমন করে? সব মানুষ তো সেই পাহাড়ি রাস্তায়!নারীপুরুষ ছেলে মেয়ে বুড়ো বুড়ি সব যেন আগুন-লাগা গাঁ থেকে হুড়মুড় করে ছুটে পালাচ্ছে নীচের দিকে।
এই একটা নতুন ঝামেলা মাঝরাস্তা থেকে এসপানিওল দলকে পোহাতে হয়েছে। বটে।
কুজকো থেকে মাঝরাস্তা পর্যন্ত আসার কোনও অসুবিধেই হয়নি। পাহাড়ি সড়ক একদম ফাঁকা। একটা আধটা এদেশি পথিক যদি বা সে পথে তখন চলে থাকে তারাও সওয়ার বাহিনীর ঘোড়ার পায়ের আওয়াজ পেয়ে যেখানে পেরেছে, লুকিয়েছে। চোখে আর তাদের দেখা যায়নি।
এখন কিন্তু এসপানিওলদের সম্বন্ধেও ভয়ডর যেন তাদের নেই। কিংবা সওয়ার বাহিনীর চেয়ে আরও ভয়ংকর কিছুকে এড়াবার জন্যে তারা যেন মরিয়া হয়ে ছুটে পালাচ্ছে। দূর থেকে শুধু আওয়াজ পেলে যারা ত্রিসীমানায় ঘেঁষত না তাদের ভিড় ঠেলে সওয়ার বাহিনীর ঘোড়া চালানোই দায় হয়ে উঠেছে।
এত ভয়টা তাদের কীসের?
সত্যি কোনও গ্রামে কোথাও আগুন তো লাগেনি। এ অঞ্চলে যা সবচেয়ে আতঙ্কের সেই ভূমিকম্প বা পাহাড়ের ধস নামারও কোনও চিহ্ন কোথাও নেই।
ফেলিপিলিও ছেড়ে যাবার পর সোরাবিয়া আর হেরাদার বাহিনীতে দোভাষী কেউ নেই। দু-চারজন সেপাই এ অভিযানে এসে সামান্য দু-চারটে এদেশি শব্দ শিখেছে মাত্র।
কাতারে কাতারে যারা নামছে এ দেশের সেই গ্রামাঞ্চলের লোকেদের কাছে জিজ্ঞাসাপত্র করে কিছুই তাই ভাল করে বোঝা যায়নি।
তারা শুধু সভয়ে কুজকোর দিকে আঙুল নেড়ে কী যেন বলেছে! যা বলেছে তার মধ্যে রেইমি কথাটা শুধু বার বার উচ্চারণের জন্যে কানে লেগেছে! তাতে এইটুকু বোঝা গেছে যে কুজকো শহরে রেইমি উৎসব সংক্রান্ত কোনও একটা ব্যাপার তাদের কাছে বিভীষিকা। সেই জন্যেই তারা সমস্ত পার্বত্য রাজ্যই ছেড়ে যত দূরে সম্ভব পালাবার চেষ্টা করছে।
এসপানিওল সওয়ার দল কাক্সামালকার দিকে যত অগ্রসর হয়েছে সংকীর্ণ পার্বত্য পথে এই শঙ্কিত পলাতক আবালবৃদ্ধবনিতার ভিড় তত বেড়ে উঠেছে। চারিদিকের গ্রামাঞ্চল থেকে বহুধারায় নেমে এসে মূল জনস্রোতে যুক্ত হয়ে তারা যেন সমতলের দিকে মানুষের ঢল সৃষ্টি করেছে।
মারধর, ধমক, হুমকিতে কোনও ফল হয়নি। যা তাদের ভিটেমাটি সব কিছু ছাড়িয়ে দিশাহারা করে ছোটাচ্ছে সে তাড়না এসপানিওলদের সম্বন্ধে আতঙ্কের চেয়ে অনেক বেশি প্রবল।
সে তাড়না যে কীসের তা কামালকায় পৌঁছোবার পর কিছুটা জানা গেছে, কিন্তু তার আগে সোরাবিয়া ও হেরাদার কুজকো থেকে সারা পথ ধাওয়া করে আসার
সমস্ত উদ্দেশ্যই পণ্ড হয়ে গেছে তাইতে।
জনতার এই বন্যাস্রোতের মধ্যে কোথায় খোঁজ করবে গানাদো আর তার সঙ্গীদের? একেবারে হাতের মুঠো থেকে হঠাৎ তারা পিছলে পালিয়েছে অপ্রত্যাশিত এই দৈবদুর্বিপাকে।
কিন্তু ব্যাপারটা কি সত্যিই অমন দৈবাধীন? কামালকায় কোনওরকমে গিয়ে পৌঁছে সোরাবিয়া এই আকস্মিক জনবন্যার কারণ কিছুটা জানতে পেরেছেন। সংক্রামক মহামারীর মতো কাক্সামালকার অধিবাসীদের মধ্যেও তখন এক দুর্বোধ্য বিভীষিকার ছোঁয়াচ লেগেছে। কুজকোর পথে যারা নেমে এসেছে তাদের সঙ্গে যোগ দিয়ে কাতারে কাতারে কাক্সামালকার অধিবাসীরাও সমতলের দিকে নামতে শুরু করেছে।
ব্যাপারটা শেষ পর্যন্ত এসপানিওল সেনাপতি পিজারোকেও না ভাবিয়ে তুলে ছাড়েনি। তাঁরই উদ্বিগ্ন অনুসন্ধানের ফলে এইটুকু জানা গেছে যে রেইমির উৎসব যা দিয়ে সূচিত হয় উত্তরায়ণের সেই সূর্য বরণ অনুষ্ঠান পেরুর ইতিহাসে এই প্রথম পণ্ড হওয়ার ঘটনা আকাশপতি পরম জ্যোতির্ময়ের চরম অভিশাপ বলে এ দেশের মানুষ তাদের অন্ধ কুসংস্কারে ধরে নিয়েছে। এ অভিশপ্ত কলুষিত ঊর্ধ্বলোক ছেড়ে তাই তারা ছুটে চলেছে সমতলের সমুদ্রতটে। সেখানে সমস্ত সৃষ্টির যিনি উৎস পাচাকামাক বা ভীরাকোচা নামে পূজিত সেই দেবাদিদেবের মন্দিরে তাভান্তিন্সুইয়ুর শাপমুক্তির জন্যে তারা ধরনা দেবে। ভীরাকোচা যদি দয়া করেন তবেই সূর্যদেবের কোপ দূর হয়ে এ দেশ অভিশাপ মুক্ত হতে পারে। তা না হলে উত্তুঙ্গ তুষারমৌলি-গিরিশিখরে বেষ্টিত সূর্যদেবের পরমপ্রিয় এ দেশ ধ্বংস হয়ে সমুদ্রের জলে তলিয়ে যাবে।