হুয়াসকার তখনও তাঁর কারা-নিবাসেই আছেন। তাঁর কক্ষদ্বারে কোনও প্রহরী কিন্তু নেই। আতাহুয়ালপার নির্দেশেই রাজপুরোহিতকে বাধ্য হয়ে যে হুয়াসকারকে। মুক্তি দিতে হয়েছে এটিই তার একটি নিদর্শন মনে হয়েছে কয়ার। নিশ্চিন্ত মনে ভেতরে গিয়ে ঢোকবার পর তাই সে স্তম্ভিত বিহ্বল হয়েছে অত বেশি। বিশ্রামকক্ষের দরজাতেই হুয়াসকার-র রক্তাক্ত মৃতদেহ তার চোখে পড়েছে। পিঠের দিকে বেঁধানো ছুরিসমেত হুয়াসকার-এর মৃতদেহ যেভাবে সেখানে পড়ে আছে তাতে একবার দেখলেই বোঝা যায় যে, হুয়াসকার অসন্দিগ্ধভাবে বিশ্বাসযোগ্য কারও সঙ্গে আলাপ সেরে বিদায় নেবার সময়ই পৃষ্ঠে এ ছুরিকাঘাত পেয়েছেন।
কয়া সরল অনভিজ্ঞ হলেও নির্বোধ নয়। তীক্ষ্ণ সহজ বুদ্ধিতে সে পৈশাচিক চক্রান্তটা অনুমান করতে পেরেছে, হুয়াসকারকে এভাবে নিহত অবস্থায় আবিষ্কার করা মানে সমস্ত অপরাধ নিজের ওপর নেওয়া। সে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব হুয়াসকার-এর সঙ্গে পরামর্শ করতে আসবে জেনেই বোধহয় রাজপুরোহিত আগের রাত্রে এ ফাঁদ পেতেছিলেন। বিশেষ প্রয়োজনে একলা দেখা করবার ছুতোয় এসে। গভীর রাত্রে ভিলিয়াক ভমুই বিদায় দেবার সময় পিছু ফেরার পর হুয়াসকারকে কাপুরুষের মতো হত্যা করেছেন এ বিষয়ে আর কোনও সন্দেহ নেই। তারপর কয়াকেই এ হত্যার জন্যে দায়ি করার ব্যবস্থা করেছেন। এক ঢিলে তাতে দু-পাখি মারবার সুবিধে হয়েছে। পথের কাঁটা হিসেবে হুয়াসকার দূর হয়েছে নিহত হয়ে, আর আতাহুয়ালপারও সর্বনাশের আয়োজন হয়েছে তিনিই দূতী পাঠিয়ে এ কাজ করিয়েছেন বলে প্রমাণের ব্যবস্থা করে।
কয়া একটু বেশি ভোরে আসার দরুনই বোধহয় হাতে হাতে ধরা পড়ার ব্যবস্থাটা এড়াতে পেরেছে। রাজপুরোহিত তাঁর সাজানো ভূমিকাটা নিতে আসার জন্যে তখন বোধহয় তৈরি হচ্ছেন।
আর এক মুহূর্ত সেখানে অপেক্ষা করেনি কয়া। শুধু নারীবেশের বদলে সোনাবরদার হিসেবে যে সাজে এসেছিল তা-ই পরে সে গুপ্ত গিরিপথে কুজকোতে রওনা হয়েছে। অমূল্য অভিজ্ঞান কোরাকেঙ্কুর পালক আর প্লান্টুর টুকরোর দরুন সে পথে কোথাও কোনও বাধা তাকে পেতে হয়নি।
কুজকো-তে এসে পৌঁছোবার পর আর একবার কিন্তু কয়াকে দিশাহারা হতে হয়েছে।
কুজকো শহরে এসপানিওল রিসালার উপস্থিতি তার কাছে স্বপ্নাতীত ঘটনা। এ শহরে কেমন করে কোথায় সে গানাদোর সন্ধান করবে। বিদেশি পাষণ্ডদের ভয়ে। দেশের মানুষ যেন মাটির তলায় গর্ত খুঁড়ে লুকিয়েছে। কোরাকেঙ্কুর পালকের এখানে কোনও দাম নেই।
শেষ পর্যন্ত সৌসার দূত সেজে এসপানিওলদের মধ্যেই গিয়ে আশ্রয় নেবার ছল তার মাথায় যে এসেছে সেটা তার বুদ্ধির বাহাদুরি বলতে হয়। এসপানিওল সেপাইদের হাতে প্রায় ধরা পড়তে পড়তে নিজেকে বাঁচাবার জন্যে এ ফন্দি তাকে অবশ্য ভাবতে হয়েছিল। এই ফন্দিতে সত্যি সত্যি সেই রাত্রেই গানাদোর দেখা পাওয়ার ও তার সঙ্গেই পালাবার সুযোগ মেলার মতো অঘটন ঘটবার আশা অবশ্য সে করেনি।
ফেলিপিলিওর সঙ্গে কোরিকাঞ্চার একজন ছোট মোহান্ত সেজে হুয়াসকার-এর হত্যার খবর নিতে এসপানিওল সওয়ারদের শিবিরে এসে দূত হিসেবে কয়াকে দেখেই গানাদো আর সেখানে সময় নষ্ট করা উচিত মনে করেননি। হেরাদার প্রতিনিধির মাথায় তাঁদের ওপর পাহারা রাখবার কল্পনাই ছিল না। সেই সুযোগ নিয়ে তৎক্ষণাৎ তিনি ফেলিপিলিও আর কয়াকে নিয়ে তাঁদের দখল করা ঘোড়ায় চড়ে রওনা হয়েছেন। সুস্পষ্ট কোনও পরিকল্পনা তখন তাঁর মাথায় ছিল না। কুজকো শহর আর এক মুহূর্তও তাঁদের পক্ষে নিরাপদ নয় বুঝে যত দূরে সম্ভব তা থেকে চলে যেতেই শুধু চেয়েছেন।
প্রায় অর্ধেক রাত সমানে ঘোড়া চালিয়ে কুজকো থেকে বেশ কিছু দূরে যে আসতে পেরেছেন সে বিষয়ে সন্দেহ নেই। তা সত্ত্বেও ক্রমশই তাঁর মনে হয়েছে যে কুজকো শহরেই লুকিয়ে থাকবার চেষ্টা করলে যা হত তার চেয়ে বেশি বিপজ্জনকই হয়ে উঠেছে তাঁদের অবস্থা। তাঁদের ঘোড়া দুটি ক্রমশ ক্লান্ত হয়ে আসছে। পথে তেষ্টা মেটাবার জল একেবারে দুষ্প্রাপ্য না হলেও খাদ্য পাবার কোনও আশাই নেই। মানুষ যদি বা উপবাসী হয়ে দীর্ঘকাল যুঝতে পারে, ঘোড়ার মতো প্রাণীর পক্ষে খাবার না পেলে এই দুর্গম পার্বত্য পথে বেশিদূর সওয়ার বয়ে ছোেটা অসম্ভব। ক্রমশই তাদের গতি মন্থর হতে হতে শেষ পর্যন্ত তারা ভেঙে পড়বেই।
রাত কেটে গিয়ে কিছুটা বেলা বাড়বার পর এক জায়গায় বাধ্য হয়েই গানাদোকে ফেলিপিলিওর সঙ্গে তাঁদের ঘোড়া রুখতে হয়েছে তাদের একটু বিশ্রাম করতে দেওয়ার জন্যে। রাস্তার ধারে ফেলিপিলিওকে ঘোড়ার পাহারায় রেখে কয়াকে নিয়ে। গানদো কাছের একটা পাহাড়ের চূড়ায় গিয়ে উঠেছেন। এ শিখরদেশ থেকে কুজকো ও কাক্সামালকার যোগাযোগের আঁকাবাঁকা পার্বত্য পথ সামনে পেছনে অনেকখানি দেখা যায়।
দূরবিন তাঁদের ছিল না। তখনও পর্যন্ত দূরবিন যন্ত্র উদ্ভাবিতই হয়নি। কিন্তু খালি চোখে সামান্য যেটুকু দেখতে পেয়েছেন তাতেই গানাদোর মুখে হতাশার হাসি ফুটে উঠেছে।
কয়ার দিকে ফিরে মুখে সেই হাসি নিয়েই বলেছেন, আর ঘোড়াগুলোর সঙ্গে নিজেদের হয়রান করে কোনও লাভ নেই, কয়া। এখানে এই চূড়ার ওপর বসে থাকলেও যা হবে ঘোড়া ছুটিয়ে পালাবার চেষ্টা করলেও তা-ই।
কয়ার দৃষ্টিশক্তি গানাদোর চেয়েও বুঝি তীক্ষ্ণ। খাড়া সব পাহাড়চূড়াকে যেন কোনও মতে জড়িয়ে কুজকো থেকে সরু একটা ফিতের মতো যে পার্বত্য পথ ঘুরে ঘুরে নেমে এসেছে তার বহুদূরের একটি বাঁকে একরাশ পিঁপড়ের মতো এসপানিওল সওয়ার সৈনিকদের সে ভালভাবেই তখন দেখতে পেয়েছে। সে সওয়ার দলের তাদের কাছে পৌঁছোতে অবশ্য তখনও অনেক দেরি। কিন্তু নিজেরা তৎক্ষণাৎ রওনা হয়েও সে বিলম্বটা আর একটু বাড়ানো যাবে মাত্র। তার বেশি কিছু নয়। কামালকায় পৌঁছোলেই যে তারা নিরাপদ তা মোটেই নয়। তবু সেখানে পর্যন্ত পৌঁছোনো তাদের হবে না। তার অনেক আগেই এসপানিওল রিসালার কাছে তাদের। ধরা পড়তে হবেই।