ফেলিপিলিওর সঙ্গী যে কে তা বোধহয় আর বলবার দরকারই নেই। কিন্তু সৌসার দূতকে দেখে তাঁর সহসা ভাবাবেগে এমন উদ্বেল হয়ে ওঠার কারণ কী?
কারণ এই যে সৌসার দূত হয়ে যে এসেছে সে আর কেউ নয়—কয়া। কামালকা থেকে সোনা-বরদার হয়ে যেভাবে সে কুজকোতে এসেছিল সেইভাবে যেন সদ্য কৈশোর-পার হওয়া তরুণের ছদ্মবেশে রাজপুরোহিত ভিলিয়াক ভুমুর কবল থেকে পালিয়ে এসেছে কোনওরকমে।
কিন্তু কেন তাকে পালিয়ে আসতে হয়েছে? দূত হিসেবে যে নিদারুণ সংবাদ সে এনেছে তা কি সত্য?
সমস্ত বিবরণই কয়ার কাছে তারপর শোনা গেছে। কিন্তু কোরিকাঞ্চার ফৌজি আস্তানায় নয়, কুজকো থেকে কাকসামালকা যাবার পথে।
সে দুর্গম পার্বত্য পথে দুটি তেজিয়ান ঘোড়া সওয়ার নিয়ে দুরন্ত বেগে তখন কাক্সামালকার দিকে ছুটে চলেছে। একটির ওপর সওয়ার হয়েছেন নারীবেশেই
কয়া-কে নিয়ে গানাদো। আর একটি চালাচ্ছে ফেলিপিলিও।
প্রাণপণ বেগে ঘোড়া দুটিকে চালানো হচ্ছে বটে, তবু নেকড়ের পালের মতো পেছনে ধাওয়া করা সোরাবিয়া ও হেরাদার বাহিনীকে এড়িয়ে পালানো কি সম্ভব হবে?
সোরাবিয়া ও হেরাদার সওয়ার দলের অনুসরণে রওনা হতে একটু বিলম্ব অবশ্য হয়েছে। গানাদো ফেলিপিলিওকে নিয়ে বার হয়ে প্রেত-প্রাসাদের দরজা বাইরে থেকে বন্ধ করে দিয়েছিলেন। প্রথমত সে দরজা খোলাতে কিছু সময় গেছে, তার চেয়ে অনেক বেশি সময় গেছে গানাদো আর ফেলিপিলিও যে সব ঘোড়ার বাঁধন কেটে ছেড়ে দিয়েছিলেন সেগুলি আবার খুঁজে আনতে।
সওয়ার দলের সকলকে জড়ো করে সোরাবিয়া হেরাদার সঙ্গে সেপাইদেরই দুটি ঘোড়ায় চড়ে আগের রাতের নিজেদের ফৌজি আস্তানায় যখন পৌঁছেছে তখন সকালের প্রথম আলো কোরিকাঞ্চার সূর্য-মন্দিরের মাথায় এসে লেগেছে।
সেখানে এসে খবর যা তারা পেয়েছে তা সত্যিই খেপিয়ে দেবার মতো।
হেরাদা যার ওপর আস্তানার ভার দিয়ে গেছল সেই অধীন সেনানী ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে জানিয়েছে যে, ফেলিপিলিওকে অবিশ্বাস করবার কথা সে ভাবতে পারেনি। হেরাদার হুকুম নিয়েই সে এসেছে মনে করে নিশ্চিন্ত বিশ্বাসে তাকে আর তার সঙ্গীকে সৌসার দূতের কাছে বিস্তারিত বিবরণ নেবার জন্যে ছেড়ে দিয়ে গেছে। তারপর ভোরবেলায় তাদের খোঁজ করতে এসে দেখেছে, অতিথিশালায় তারা কেউ নেই। অস্থির হয়ে কুজকো শহরের চারিধারে সে সন্ধান করিয়েছে তন্ন তন্ন করে। তাদের কোথাও পাওয়া যায়নি। শুধু ভীত দু-একজন কুজকোবাসীর মূক ইশারায় যা বোঝা গেছে তাতে সন্দেহ হয় দু-টি ঘোড়ায় চেপে কুজকো থেকে কাক্সামালকার পথেই. তাদের তিনজনকে যেতে দেখা গেছে।
সোরাবিয়া জিজ্ঞাসাবাদ করে আর বৃথা সময় নষ্ট করেনি। তার প্রচণ্ড রাগ শুধু কয়েকটা কুৎসিত গালাগাল আর হতভাগা সেনানীর গণ্ডে বিরাশি সিক্কার চপেটাঘাতে প্রকাশ করে হেরাদাকে নিয়ে সেই মুহূর্তেই সে কাক্সামালকার পথে রওনা হয়েছে সমস্ত দল নিয়ে।
পলাতক দল কয়েক দণ্ড আগে বার হতে পেরেছে ঠিকই। কিন্তু কতক্ষণ তারা এগিয়ে থাকতে পারবে। দুটি মাত্র ঘোড়া তাদের সম্বল! এসপানিওল রিসালার মতো বাড়তি ঘোড়া তাদের সঙ্গে নেই। নেই সেপাই আর ঘোড়ার দানাপানির ব্যবস্থাও।
একটি ঘোড়ার সওয়ারি আবার তাদের দুজন।
যত তাড়াতাড়িই রওনা হয়ে প্রাণপণে ঘোড়া ছোটাক না কেন, কামালকা পৌঁছোবার আগেই ধরা তারা পড়তে বাধ্য। এ পথের কোথাও কোনও ফ্যাকড়াও নেই যে তা দিয়ে পালাবার চেষ্টা করবে। কুজকো থেকে কামালকায় নামার পাহাড়ি দুর্গম সংকীর্ণ পথ ওই একটিই।
নিজের ঘোড়ার পিঠে কয়াকে নিয়ে ফেলিপিলিওর সঙ্গে যথাসাধ্য তাড়াতাড়ি কাক্সামালকার দিকে নামতে নামতে গানাদো নিজেই সে কথা ভাল করে বুঝেছেন। তাঁরা এসপানিওল রিসালার দুটি সেরা ঘোড়া পেয়েছেন ঠিকই। কিন্তু শুধু দুটি ঘোড়া নিয়ে সোরাবিয়ার এসপানিওল সওয়ার দলের সঙ্গে তাঁদের ব্যবধান বেশিক্ষণ বজায় রাখা যাবে না।
সোনাবরদার দলে যে তার সঙ্গী হয়েছিল সেই পাউলো টোপা থাকলে এই দুর্গম পাহাড়ি পথেও শুধু ইংকা বংশের লোকদের জানা গোপন লুকোবার জায়গার হদিস দিতে পারত। কিন্তু ফেলিপিলিও সামান্য একজন নাগরিক মাত্র, অভিজাত বংশেরও নয়। সে এসব আস্তানার কিছুই জানে না। কন্যাশ্রমের চার দেয়ালের মধ্যে লালিতা সূর্যকুমারী হিসেবে কয়ার তো এসব কিছু জানবার সুযোগই হয়নি জীবনে।
পেছনে হিংস্র নেকড়ের পালের মতো যারা আসছে তাদের হাতে ধরা পড়া অনিবার্য জেনেও গানাদো অবশ্য আত্মসমর্পণের জন্যে প্রস্তুত হয়নি। তাঁর পিঠের সঙ্গে লগ্ন কয়ার কোমল দেহের মধুর উত্তাপ সমস্ত শিরায় শিরায় প্রবাহিত রক্তস্রোতে অনুভব করে চরম হতাশার মধ্যেও আসন্ন ভয়ংকর নিয়তি ঠেকাবার উপায়ের কথা ভেবেছেন।
ইতিমধ্যে কয়ার কাছে সৌসার নিদারুণ বিপর্যয়ের বৃত্তান্ত বিশদভাবে শুনেছেন। ঘোড়ার পিঠে তাঁকে দু বাহুতে বেষ্টন করে পিছনে বসে কয়া তাঁর কানের কাছে মুখ রেখে সে বিবরণ শুনিয়েছে।
রাজপুরোহিত ভিলিয়াক ভমু প্রথমে হুয়াসকারকে কয়ার বিরুদ্ধে সন্দিগ্ধ ও বিরূপ করে তোলবার চেষ্টা করেন। কোরাকেঙ্কুর দুটি পালক আর ইংকা নরেশের উষ্ণীষের রক্তিম ল্লান্টুর টুকরোটুকুর দরুন সে চেষ্টা বিফল হবার পর তিনি যে অমন পৈশাচিক চক্রান্ত করবেন কয়া তা ভাবতে পারেনি। যে সন্ধ্যায় ভিলিয়াক ভমুর সামনে হুয়াসকারকে তার অভিজ্ঞান দেখিয়ে সে নিজের বিশ্বস্ততার প্রমাণ দেয় তার পরের দিন ভোর না হতেই সে আবার গিয়েছিল হুয়াসকার-র বিশ্রাম কক্ষে তাঁর সঙ্গে সাক্ষাতের জন্যে। গানাদোর শিখিয়ে দেওয়া কয়েকটি কথা গোপনে হুয়াসকারকে তার বলার ছিল।