এ আওয়াজটা সোরাবিয়ার কানেও গেছে অস্পষ্টভাবে। কিন্তু আওয়াজ লক্ষ করে যে তলোয়ার সে চালিয়েছে তাতে মশাল রাখবার রুপোর ভৃঙ্গারটাই ঝনঝন শব্দে অন্ধকার গুহা কাঁপিয়ে যেন আর্তনাদ করে উঠেছে।
একটা আর্তনাদের মতো শব্দ কয়েক মুহূর্ত বাদে গুহা মুখেও শোনা গেছে। সেখানকার বিশাল দরজাটা বন্ধ হয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে।
গুহা মুখের দরজা বন্ধ হল কেমন করে? কে করলে? সোরাবিয়া আর হেরাদা অন্ধকার প্রেত-প্রাসাদকক্ষে চারিদিকে সাজানো নানা মহামূল্য ঐশ্বর্যবিলাসের উপকরণের মধ্যে হোঁচট খেতে খেতে দরজার দিকে ব্যাকুলভাবে ছোটবার চেষ্টা করেছে। দরজার কাছাকাছি যারা ছিল সেই সওয়ারসৈনিকদের কোনও একজনের বন্ধ দরজার ওপর ভীত করাঘাতের শব্দই নিশানা হয়েছে আর সকলের।
প্রেত-প্রাসাদের বাইরেও তখন একটা হুলস্থুল বেধেছে। সোরাবিয়ার সঙ্গে যারা আগে এসেছিল, তারা, হেরাদা ও তার রক্ষীদলের হঠাৎ এমন করে এ জায়গায় উপস্থিত হওয়ায় উৎসুক ও উত্তেজিত হয়ে ব্যাপারটা পরস্পরের মধ্যে আলোচনা করছিল। হঠাৎ তাদের ভেতর দিয়ে একটা ঘূর্ণিঝড় যেন বয়ে গিয়েছে।
নিজেদের মধ্যে তন্ময় হয়ে আলাপ করতে করতে প্রেত-প্রাসাদের দরজাটা হঠাৎ সশব্দে বন্ধ হওয়াই তাদের চমকে সজাগ করে তুলেছিল। দরজা বন্ধের সে শব্দের পরই কাছাকাছি খুঁটি পুঁতে বেঁধে রাখা তাদের ঘোড়াগুলো যেন খেপে গিয়েছে মনে হয়েছে। ঠিক নেকড়ের পালের সামনে পড়ার মতো আতঙ্কের ডাক ছেড়ে অস্থির হয়ে। লাফালাফি করে তারা যেন দড়িদড়ার বাঁধন ছিঁড়েই সব যেদিকে খুশি অন্ধকারে ছুটে পালিয়েছে।
সেদিকে খোঁজ নিতে যাবে কী, ওদিকে গুহামুখের দরজার ওপর তখন আকুল পরিত্রাহি ঘা পড়ছে ভেতর থেকে!
সেপাইদের ব্যাপারটা ভাল করে বুঝতেই বেশ কিছুটা সময় গেছে। সব গোল মেটাতে আরও অনেক বেশি।
গুহামুখের দরজার বাইরে থেকে দেওয়া হুড়কো খুলে দিয়ে সোরাবিয়া ও হেরাদার সঙ্গে আটকে-পড়া সওয়ার সেপাইদের বার করবার পর ঘোড়াগুলোর খোঁজ পাওয়া সহজ হয়নি। খোঁজ করতে গিয়ে দেখা গেছে ঘোড়াগুলো নিজে থেকে দড়িদড়া ঘেঁড়েনি। খুঁটিতে বাঁধা তাদের দড়িগুলো সব কাটা।
এদিকে ওদিকে পালানো ঘোড়াগুলো প্রায় সবই শেষ পর্যন্ত উদ্ধার করা গেছে। যায়নি শুধু দুটো। মার্কুইসরূপী সোরাবিয়া আর দলপতি হেরাদার সেরা ঘোড়া দুটোই একেবারে নিখোঁজ।
সে ঘোড়ায় চড়ে কারা যে পালিয়েছে তার হদিসও পাওয়া গেছে। সোরাবিয়া আর হেরাদার সঙ্গে যারা এ প্রেত-প্রাসাদে এসেছিল তাদের মধ্যে শুধু ফেলিপিলিওর কোনও পাত্তা নেই। আর হুইয়ানো কাপাক-এর শবদেহে পরানো রাজবেশটা প্রেত-প্রাসাদের বাইরে ঘোড়াগুলো যেখানে বাঁধা ছিল তারই কাছাকাছি ছেড়ে ফেলা খোলসের মতো পড়ে আছে।
পালিয়ে যাওয়া সব ঘোড়া খুঁজে পেতে ধরে এনে জড়ো করতে রাত প্রায় শেষ। হয়ে এসেছিল। ভোরের সেই আবছা আলোতেই হেলায় ফেলে-যাওয়া সোনা-রুপোর কাজে জমকালো রাজবেশটা দেখে সোরাবিয়ার দুচোখ দিয়ে যেন আগুন ঠিকরে বেরিয়েছে।
রাজবেশের খোলস ফেলে যাওয়ার রহস্য সে তার শয়তানি বুদ্ধিতে কিছু আঁচ করতে পেরেছে কি?
২৯. মেঘ-ছোঁয়া উত্তুঙ্গ পাহাড় চূড়া
মেঘ-ছোঁয়া উত্তুঙ্গ পাহাড় চূড়ার রাজ্য তাভান্তিন্সুইয়ু! তার ইতিহাসের চরম বিপর্যয়ের সঙ্গে যিনি জড়িত তাঁর কাহিনী ওদেশের জলপ্রপাতের মতোই এবার মন্থর থেকে দ্রুত হয়ে মালভূমির ঊর্ধ্বলোক থেকে সবেগে সমতলে নেমে গিয়েছে।
প্রেত-প্রাসাদের সামনে বিমূঢ় অস্থির সওয়ার সৈনিকের দল যখন সোরাবিয়া আর হেরাদার নির্দেশে তাদের পলাতক ঘোড়ার সন্ধান করছে কোরিকাঞ্চায় সাময়িক ফৌজি আস্তানা হিসেবে দখল করা অতিথিশালায় তখন বেশ একটু সাড়া পড়ে গিয়েছে।
সাড়া পড়েছে ফেলিপিলিওর জন্যে। সে যেন হেরাদার কাছ থেকেই খবর পেয়ে তার হুকুমে সৌসা থেকে হুয়াসকার-এর হত্যার খবর-আনা দূতের সঙ্গে দেখা করতে। চেয়েছে। সঙ্গে আবার একজন কোরিকাঞ্চার ছোট মোহান্তকেও আনতে ভোলেনি। হেরাদার তাকে এ কাজে পাঠানো অবশ্য স্বাভাবিক বলেই মনে হয়েছে সকলের। দূত হিসেবে যে এসেছে সে প্রথম এখানে এলে তার কথা সম্পূর্ণ বুঝে বোঝাবার মতো দোভাষী কাউকে তো পায়নি। কোনও রকমে হুয়াসকার আর ভিলিয়াক ভূমুর নামগুলো বার বার উচ্চারণ করে মূক অভিনয়ে ব্যাপারটা বুঝিয়ে দিয়েছে।
এখন ফেলিপিলিও তার কাছে সমস্ত ব্যাপারটা ভাল করে জেনে নিতে পারবে। কোরিকাঞ্চার ছোট একজন মোহান্তকে সঙ্গে নিয়ে এসেছে সে সেই উদ্দেশ্যে। সৌসার কাছে রাজপুরোহিত ভিলিয়াক ভূমু সম্বন্ধে প্রশ্ন করবার জন্যে একজনকে দরকার।
হেরাদা সৌসার দূতের আনা খবর ভাসাভাসা ভাবে বুঝে, ব্যস্ত হয়ে মার্কুইস-এর খোঁজে প্রেত-প্রাসাদের উদ্দেশে যাবার আগে তার অধীন যে সৈনিকের ওপর আস্তানার ভার দিয়ে গেছল সে ফেলিপিলিও বা তার সঙ্গীকে সন্দেহ করবার কথা কল্পনাই করেনি। সন্দেহ করবার কোনও কারণই অবশ্য তার ছিল না। এসপানিওল বাহিনীতে বিশেষভাবে সম্মানিত ও একান্ত বিশ্বাসী দোভাষীর এরই মধ্যে কী গভীর রূপান্তর হয়েছে তা আর সে জানবে কেমন করে?
অতটা নিশ্চিন্ত বিশ্বাস না থাকলে সৌসার দূতকে ফেলিপিলিও ও তার সঙ্গীর সামনে এনে হাজির করবার পর একটা জিনিস অন্তত সে লক্ষ করত। চেষ্টা করা সত্ত্বেও ফেলিপিলিওর সঙ্গীর মুখে এক সঙ্গে বিস্ময়-আনন্দ-ভয় উত্তেজনার অস্থির অদম্য প্রকাশ তার দৃষ্টি তা হলে বোধহয় এড়াত না।