এখান থেকে আর পেছিয়ে যাবার বা এপাশে-ওপাশে পালাবার কোনও উপায় নেই।
মার্কুইস-এর মুখের দিকে চেয়ে ফেলিপিলিও মনে মনে নিরুপায় হতাশ রাগে গুমরেছে। একটা ইঁদুরকে থাবার তলায় চেপে রেখে শেষ মারে নিকেশ করবার জন্যে বেড়ালের মুখে যা ফুটে ওঠে তার চেয়ে অনেক পৈশাচিক একটা হিংসার উল্লাস মার্কুইসের চোখ মুখে তখন জ্বলছে।
মার্কুইস জানে ইস্পাতের তলোয়ারের শুধু একটা কি দুটো কোপ দেওয়ার অপেক্ষা। সে কোপ ঠেকাবার মতো কোনও কিছু ওই ভুতুড়ে মূর্তির হাতে বা ধারে কাছে নেই। তার ভুতুড়ে ক্ষমতার পরিচয় তো এখনও পর্যন্ত কিছু পায়নি। সোরাবিয়ার সাহস সেই জন্যেই এত বেশি। এ বাঁদির বাচ্চাদের দেশের ভূতের জারিজুরিও তার মতো ধনী সভ্য মানুষের কাছে খাটে না বলে তার তখন দৃঢ় বিশ্বাস হয়েছে।
শেষ কোপটা দেওয়া অবশ্য তখনই হয়নি। বাধা পড়েছে আচমকা।
হঠাৎ গুহামুখে বেশ একটু হট্টগোল শোনা গেছে।
সোরাবিয়া একটু অবাক হয়েছে সে গোলমালে। তার সওয়ার সেপাইরা তো ভয়েই কাঠ হয়ে ছিল এর আগে। তারাই শেষ পর্যন্ত ভীরুতার লজ্জায় মরিয়া হয়ে তার সঙ্গে যোগ দিতে আসছে না কি?
কোণঠাসা ভুতুড়ে মূর্তির ওপর কড়া নজর রেখে সোরাবিয়া গুহামুখে যারা ঢুকছে তাদেরও একটু লক্ষ করেছে।
সওয়ার সেপাই-এর কয়েকজন প্রেত-প্রাসাদের দরজা দিয়ে ঢুকেছে বটে, কিন্তু এ তো তার সঙ্গে যারা এসেছিল তাদের কেউ নয়। কোরিকাঞ্চার রাতের আস্তানায় যাদের রেখে এসেছিল এরা তো তাদেরই ক-জন!
তাদের ভেতর থেকে হেরাদাকে এগিয়ে আসতে দেখে আরও অবাক হয়েছে।
হেরাদা উত্তেজিতভাবে সোরাবিয়ার কাছে এসে যা বলেছে তাতে অবশ্য রক্ষীদল। নিয়ে হঠাৎ তার এই প্রেত-প্রাসাদে ছুটে আসার কারণটা আর অস্পষ্ট থাকেনি।
কারণটা সত্যিই যেমন অপ্রত্যাশিত তেমনি অবিশ্বাস্য! এদেশের রাজনীতি সম্বন্ধে বিশেষ কোনও মাথা ব্যথা সারাবিয়ার নেই। তবু হেরাদা যা খবর জানিয়েছে তাতে তাকে বেশ একটু বিচলিত হতে হয়েছে।
চলুন, এখুনি ফিরে চলুন মার্কুইস! প্রথমেই অত্যন্ত উত্তেজিত অস্থিরতার সঙ্গে বলেছে হেরাদা!
কেন, কী, হয়েছে কী? বিস্মিত উদ্বেগের সঙ্গে একটু বিরক্তি নিয়েই জিজ্ঞাসা করেছে সোরাবিয়া। আশ মিটিয়ে হাতের সুখ করবার এমন একটা মুহূর্তে বাধা পড়ায় সে খুশি নয় তখন।
যা হয়েছে তাতে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব আমাদের কামালকায় ফেরা দরকার। প্রায় আদেশের স্বরেই যেন বলতে বাধ্য হয়েছে হেরাদা, সেনাপতি পিজারোর কাছে খবরটা পৌঁছে দেবার দায়িত্বও আমাদের।
কিন্তু খবরটা কী সেটা তো এখনও জানতে পারলাম না। সোরাবিয়া মার্কুইস হিসেবে তার অধৈর্যটা একটু মেজাজ দেখিয়েই প্রকাশ করেছে।
উত্তেজিত অবস্থায় আসল কথাটা জানাতেই ভুল হয়ে গিয়েছিল বটে হেরাদার। সে ত্রুটি সংশোধন করে হেরাদা এবার যা জানিয়েছে তা খবর হিসেবে সত্যিই সাংঘাতিক।
রাজপুরোহিত ভিলিয়াক ভমু সৌসা দুর্গে বন্দি আতাহুয়ালপার বৈমাত্রেয় রাজভ্রাতা পরাজিত ভূতপূর্ব ইংকা হুয়াসকারকে হত্যা করিয়েছে।
হুয়াসকারকে হত্যা করিয়েছে রাজপুরোহিত! এ রাজ্যের বেশি কিছু না জেনেই। চমকে উঠেছে সোরাবিয়া।
চমকটা যে শুধু তার একার নয়, সজাগ থাকলে সোরাবিয়ার তা দৃষ্টি এড়াত না।
ফেলিপিলিওর দৃষ্টি তা এড়ায়নি। নিজের স্তব্ধ বিহ্বলতা নিয়েই শবমূর্তির দিকে সবিস্ময়ে চেয়ে সে হেরাদার পরের ব্যাখ্যাটা শুনেছে।
হ্যাঁ, হেরাদা গম্ভীর স্বরে জানিয়েছে, সৌসা থেকে এইমাত্র এক দূত এসে পৌঁছেছে এই ভয়ংকর খবর নিয়ে! যে সওয়ারদের নিয়ে আপনি এখানে এসেছেন তাদেরই একজন বেশি নেশা করে বেসামাল হয়ে আপনার সঙ্গে এ দলে যোগ দিতে পারেনি। তার কাছেই জায়গাটার হদিস নিয়ে আমি ছুটে আসছি। চলুন, আর দেরি করবার সময় নেই।
আছে! একটু তিক্ত উদ্ধত স্বরেই বলেছে সোরাবিয়া, এই দানোয় পাওয়া মড়াটাকে কয়েক টুকরো করে এ সোনার সিংহাসনটা টেনে নিয়ে যাবার মতো সময় অন্তত আছে।
সোরাবিয়া তার তলোয়ারটিকে বাগিয়ে তুলতে গেছে শেষ কোপ দেবার জন্যে।
কিন্তু ওই পর্যন্তই।
হঠাৎ সমস্ত গুহা একেবারে অন্ধকার হয়ে গেছে। অন্ধকার হয়ে গেছে দেওয়ালের ধারে ভৃঙ্গারে বসানো মশালটার জ্বলন্ত মাথাটাই কাটা হয়ে মেঝের ওপর ঠিকরে পড়বার দরুন।
মশালের মাথাটা কেটে গেছে তীরবেগে ছোঁড়া অব্যর্থ একটা খাটো তলোয়ারের ঘায়ে। ইস্পাতের বদলে সামান্য ব্রোঞ্জের তৈরি হলেও এ কাজটা তাতে নিপুণভাবেই হয়েছে।
পাথুরে মেঝের ওপর ছেতরে পড়ে মশালের মাথার আগুনটা দুবার একটু যেন খাবি খেয়েছে। তার পর একেবারে গেছে নিভে।
আর সকলের মতো সোরাবিয়ার চোখ আপনা থেকেই ছিটকে পড়া মশালের মাথাটার সঙ্গে মেঝের ওপরেই গিয়ে পড়েছিল। আগুনটা সেখানে নিভে যাবার পর চোখ ফেরাতে গিয়ে সবদিক দিয়েই সে সত্যিকার অন্ধকার দেখেছে।
গুহার ভেতরে একেবারে কালি-ঢালা অন্ধকার। হেরাদার সঙ্গে যে দু-চারজন সেপাই ভেতরে এসে ঢুকেছিল তারা কেউ মশাল সঙ্গে আনেনি।
হঠাৎ এ অন্ধকারে সোরাবিয়া ও হেরাদার সঙ্গে তারাও চমকে হতভম্ব আর দিশেহারা হয়ে পড়েছে। নিজেদের কারও গায়ে লাগতে পারে জেনেও বেপরোয়া হয়ে সোরাবিয়া তলোয়ার চালিয়েছে সামনের দিকে। কিন্তু বৃথাই।
এরই মধ্যে ফেলিপিলিও তার হাতে একটা হেঁচকা টান টের পেয়েছে। সেই সঙ্গে কুইচুয়া ভাষায় একটা চাপা গলার আদেশ—এসো। ভয় পেয়ো না।