সোরাবিয়ার বুকের ভেতরটা হিম হয়ে যায় ভয়ে বিহ্বলতায়। কিন্তু চরম আতঙ্কই যেন একটা উদ্ধত উন্মত্ততা এনে দেয় তার ভেতরে।
হিংস্রভাবে পাগলের মতো হেসে উঠে সে বলে, ভূত-প্রেত-দানব, কে তুই জানি। সাহস যদি থাকে তা হলে সামনে আয়। তোর আশ্রিত যাকে বলছিস তোর সামনেই তাকে হত্যা করছি দেখ।
সোরাবিয়া নিপুণ অসিযোদ্ধার কৌশলে ডান পা একটু মুড়ে সামনে বাড়িয়ে ফেলার সঙ্গে সঙ্গে প্রসারিত ডান হাতের তলোয়ারটা চক্ষের নিমেষে কাঁধ থেকে সোজা সামনে চালিয়ে দেয়।
এখনকার ফেনসিং-এর ভাষায় এটা একেবারে নিখুঁত লাঞ্জ। এ মার ঠেকাবার, একমাত্র চাল হল সেই ভাষায়—প্যারা অফ প্রাইম।
ফেনসিং-এর এ সব নামই সে যুগে বানানো হয়নি। তবে কৌশলগুলো একেবারে অজানা ছিল না। নাম না জেনেই সোরাবিয়া তলোয়ারের যে চাল চেলেছিল তা মোক্ষম।
ঠেকাবার পালটা চাল জানা না থাকায় ব্যর্থ প্রতিরোধের চেষ্টায় সোরাবিয়ার সেই এক খোঁচাতেই ফেলিপিলিওর হৃদপিণ্ড এফোঁড় ওফোঁড় হয়ে যাবার কথা।
কিন্তু তা হয় না।
হঠাৎ চরম মুহূর্তে একটা ভারী জিনিস সোরাবিয়া আর ফেলিপিলিওকে ছাড়িয়ে একটু দূরে সশব্দে মেঝের ওপর গিয়ে পড়ে।
পড়বার আগে সোরাবিয়ার তলোয়ারের ডগাটা তাতে একটু নড়ে গিয়ে ফেলিপিলিওকে বাঁচিয়ে দিয়ে যায়।
সোরাবিয়া আর ফেলিপিলিও দুজনেই চমকে উঠে ঘাড় ঘুরিয়ে মেঝের ওপর সশব্দে গিয়ে পড়া বস্তুটা দেখে।
ব্রোঞ্জের তৈরি একটা ভারী এদেশি রণকুঠার। রণকুঠারটা কে কোন দিক থেকে ছুঁড়েছে আর বুঝতে বাকি থাকে না।
এ রণকুঠারটা খানিক আগে পর্যন্ত যার হাতে শোভিত দেখা গেছল ইংকা নরেশ হুয়াইনা কাপাক-এর সেই রাজবেশে সাজানো শবমূর্তিকেই ধীরে ধীরে এবার উঠে দাঁড়াতে দেখা যায়। মুখোশ-ঢাকা তার মুখ, সারা গায়ে সোনা রুপো জড়োয়ার কাজে ঝলমল পোশাক আর হাতে একটা তলোয়ার।
কিন্তু সে ব্রোঞ্জের তৈরি খাটো তলোয়ার তো এসপানিওলদের সরেস ইস্পাতে গড়া লম্বা অসি ফলকের কাছে ছেলেখেলার জিনিস।
সোরাবিয়া প্রথমে নিজেকে সামলাতে না পেরে ভয়ে কয়েক পা পিছিয়ে গেলেও সেই কথাই ভাবে। আর ফেলিপিলিও আশঙ্কায় উৎকণ্ঠায় যেন নিশ্চল হয়ে গিয়ে একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকে সেই মূর্তির দিকে।
ইংকা নরেশ হুয়াইনা কাপাক কি সত্যিই এবার জাগলেন? কিন্তু কী করবেন তিনি ওই সামান্য সেকেলে অস্ত্র নিয়ে এই এসপানিওলদের বিরুদ্ধে, তাদের নিজেদের ধর্মের সবরকম পাপের অধীশ্বর স্বয়ং শয়তানই যাদের সহায়?
সত্যিই যদি জেগে থাকেন তবু ইংকা শ্রেষ্ঠ হুয়াইনা কাপাক তাঁর সঞ্জীবিত শবদেহে কিছুই যে করতে পারছেন না, ফেলিপিলিও সশঙ্ক হতাশায় তা দেখতে পায়।
কেমন করেই বা করবেন!
হাতে তাঁর সামান্য একটা সেকেলে দুর্বল অস্ত্র যা সাধারণ একটা ছোরার একটু দীর্ঘ সংস্করণ ছাড়া আর কিছু নয়। এ দীর্ঘ ছোরা আবার ব্রোঞ্জের। তামা আর টিন মেশাবার অসামান্য কৌশলে এ ব্রোঞ্জ পেরুর ললাকেরা যত কঠিনই করে তুলে থাকুক, ইস্পাতের তলোয়ারের সঙ্গে তার কি তুলনা হয়!
তাও আবার ইউরোপের সেরা অস্ত্রের কাজ তখন যেখানে হয় স্পেনের সেই টোলেডো শহরের বিখ্যাত কারিগরের তৈরি সরেস ইস্পাতের বেঁধবার ও কোপ দেবার সুচোলো আর দু-দিকে সমান ধারালো তলোয়ারের সঙ্গে। এত কথা ফেলিপিলিওর জানা নেই। কিন্তু মার্কুইস যে ক্রমশ জয়ী হচ্ছে তা বুঝতে তার দেরি হয়নি।
রাজবেশ পরা মৃতদেহকে সিংহাসন থেকে উঠে এগিয়ে আসতে দেখে প্রথমটা হকচকিয়ে গিয়ে সারাবিয়া নিজের অজান্তেই কয়েক পা পিছিয়ে এসেছিল, তারপর তার ওপর সত্যি শয়তানই যেন ভর করেছে মনে হয়েছে। তার মুখটা হিংস্র দেখিয়েছে সেইরকমই।
এ হিংস্র উল্লাস অকারণে হঠাৎ তার মুখে ফুটে ওঠেনি। ভূত প্রেত যা-ই হোক, রাজবেশ-পরা মড়াটা তাঁর সঙ্গে অস্ত্র নিয়ে যুঝতে আসছে এটুকু বুঝেই সোরাবিয়া তখন বুকে নতুন বল পেয়েছে।
আর অস্ত্রই বা কী! ব্রোঞ্জের একটা খাটো তলোয়ার! ঠিকমতো চালাতে পারলে তার তলোয়ারের এক ঘায়ে ও তলোয়ার দু-টুকরো হয়ে যাবে।
গেছেও প্রায় তাই।
সোরাবিয়া তলোলায়ারের খেলায় ইউরোপের সেরা গুণীদের একজন। তাকে একবার একজন শুধু একটা বড় ছোরা নিয়েই বেশ একটু বেকায়দায় যে ফেলেছিল, সোরাবিয়ার মনের গোপনে সে স্মৃতির জ্বালা এখনও অবশ্য আছে। কিন্তু আর যাই হোক সে ছোরাটা ছিল ইস্পাতের, আর তার নিজের দেশের এক বিশেষ দাঁত কাটা ধরনে তৈরি।
এ ঠুনকো ব্রোঞ্জের হাতিয়ার সে ইস্পাতের ছোরার কাছে খেলনা মাত্র। আর দানোয় পাওয়াও যদি হয় তাহলেও এই জাগানো মড়া, তার স্ত্রী আনার পেয়ারের সেই গোলাম নয়।
সোরাবিয়া অকুতোভয়ে তার তলোয়ার চালিয়েছে। দু-টুকরো না হয়ে গেলেও সে মার ঠেকাতে গিয়ে ব্রোঞ্জের খাটো তলোয়ারের একটা চোলা তাতে উঠে গিয়েছে।
সোরাবিয়া নিজের অস্ত্র প্রাধান্যের এ সুবিধেটুকু ষোলো আনা কাজে লাগাতে ত্রুটি করেনি। নির্মম অমোঘ নিয়তির মতো সে একটু একটু করে কোণঠাসা করে এনেছে সে শবমূর্তিকে।
অস্ত্রবিদ্যায় মৃত ইংকা নরেশ তেমন অপটু যে ছিলেন না তাঁর শবমূর্তির চালনা-কৌশল দেখে ফেলিপিলিও তা ভাল করেই বুঝেছে। কিন্তু দীর্ঘতর অনেক জোরালো ও ভিন্ন জাতের ইস্পাতের অস্ত্রের কাছেই হার মানতে হয়েছে ব্রোঞ্জের খাটো তলোয়ারকে।
মাঝে মাঝে অদ্ভুত ঘোরা-ফেরার কায়দায় কোনওরকমে মার্কুইসকে এড়িয়েও শেষ পর্যন্ত শবমূর্তি উঁচু বেদির ওপর বসানো তাঁর সিংহাসনের পেছনেই আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছেন।