দৈববাণী থেমে গিয়েছে। শুধু ওই সোনার সিংহাসনটা টেনে নিয়ে গেলেই তো হয়!
ঝলমল পোশাকে যে মড়াটা ওর ওপর বসানো আছে সেটাকে শুধু একটু সরাতে হয় এই যা।
মড়াটাকে খুব তাচ্ছিল্য এখন আর অবশ্য করতে পারে না। যে ভুতুড়ে শাসানিটা সে এই মাত্র শুনেছে সেটা তো ওই সাজানো লাশটা যার সেই কোন মরা ইংকার প্রেতের গলা থেকেই বেরিয়েছে বলে ধরতে হয়। এ প্রেত-প্রাসাদ তো তারই। এ প্রাসাদ অপবিত্র করার বিরুদ্ধে অভিশাপের ভয় সে-ই দেখাতে পারে।
বুকটা সোরাবিয়ার বেশ কেঁপে ওঠে। তবু সোনার লোভে মরিয়া হয়ে একবার শেষ চেষ্টা করবার জন্যে নিজেকে সে জোর করে শক্ত করে রাখে।
সিংহাসনটা টেনে নিয়ে যাবার জন্য মড়াটাকে তার ওপর থেকে ফেলে দিতে হবে। মড়াটাকে তার জন্যে হাত দিয়ে ছোঁবার দরকারই বা কী?
তলোয়ারের খোঁচাতেই সেটাকে সিংহাসন থেকে নামিয়ে দিলেই তো হয়।
অভিশাপের ভয়? একবার এই ভুতুড়ে গুহা থেকে বার হতে পারলে আর কোনও অভিশাপ তাকে স্পর্শ করতে পারবে কি?
সঙ্গে হেরাদাই তো আছে তাদের পুরুত! তার কাছে গিয়ে একবার ক্রুশ ছুঁয়ে নিজের জন্যে কিছু মানত করলে এ অভিশাপ কেটে যেতে কতক্ষণ।
যা করবার তাড়াতাড়ি করে ফেলতে হবে শুধু।
তলোয়ারটা খাপ থেকে খুলে বাগিয়ে ধরে সোরাবিয়া এগিয়ে যায় সিংহাসনে বসানো মড়াটার দিকে।
তলোয়ারটা বাড়িয়ে সেটাকে খোঁচানো কিন্তু আর হয়ে ওঠে না।
খবরদার!
একটা তীক্ষ্ণ ক্রুদ্ধ হুকুম শুনে তাকে থমকে যেতে হয়।
না, এবার অশরীরী ভৌতিক প্রায়-চুপিচুপি বলা কোনও সাবধান বাণী নয়, স্পষ্ট, কুদ্ধ জোরালো উচ্চারণ।
কণ্ঠটা আর কারও নয়, ফেলিপিলিওর।
তার সে ভয়ে বিবর্ণ চেহারা এখনও বদলায়নি, কিন্তু অসাড় আচ্ছন্নতার জায়গায় তার দু-চোখে একটা অস্বাভাবিক আগুন যেন জ্বলছে।
এ প্রেত-প্রাসাদের যিনি অধীশ্বর তাঁর নিষেধবাণী নিজের কানে শোনবার পর এত কালের ফেলিপিলিও সে বুঝি আর নেই!
নিজেকে সে জাতির কুলাঙ্গার বলেই জানে। এই এসপানিওলদের কাছেই নিজেকে বিকিয়ে সে এদের গোলাম হয়ে গেছে একথা মিথ্যা নয়। তা ছাড়া মার্কুইস। কেন, যে কোনও এসপানিওল অসিযযাদ্ধার সঙ্গে যোঝবার মতো শিক্ষা কি শক্তি তার নেই। তবু ঘৃণ্য নীচ বিদেশির হাতে এ পবিত্র প্রেত-প্রাসাদের অপমানের বিরুদ্ধে তাকে দাঁড়াতেই হবে। বিশেষ করে ইংকা-শ্রেষ্ঠ স্বয়ং হুয়াইনা কাপাক-এর মৃতদেহ তলোয়ার দিয়ে এই বিদেশি পাষণ্ড তার চোখের সামনে খোঁচাবে এ সহ্য করা তার পক্ষে অসম্ভব।
তাদের জাতির, তাদের ধর্মের সে-ই এখানে একমাত্র প্রতিনিধি। সে প্রতিনিধিত্বের মর্যাদা সে রাখবে।
সোরাবিয়া ফেলিপিলিওর চিৎকারে প্রথমটা হকচকিয়ে গিয়েছে। এমনিতেই তার মনের তখন বেশ একটু অস্বাভাবিক অবস্থা, তার ওপর এই তীক্ষ্ণ কণ্ঠের খবরদার আওয়াজটা তার ভেতরটা পর্যন্ত কাঁপিয়ে দিয়েছে অদম্য আতঙ্কে।
প্রথম থমকে যাওয়ার পরে ফিরে তাকিয়ে সে আওয়াজের উৎসটা বুঝতে পারে। আর কেউ নয়, ফেলিপিলিওই তাকে এ ধমক দিয়েছে এটা উপলব্ধির পর কয়েক মুহূর্ত আতঙ্কটা বিমূঢ় বিস্ময় হয়ে তাকে বিহ্বল করে রাখে। তারপর সেই বিহ্বলতাটা বোমার বারুদের মতো প্রচণ্ড রাগে ফেটে পড়ে।
এ প্রেত-প্রাসাদের বুকের ভেতর পর্যন্ত জমিয়ে দেওয়া হিমেল ভয়ের স্পর্শটা যেন সে রাগের উত্তাপে খানিকক্ষণের জন্যে আর টের পাওয়া যায় না।
হিংস্রভাবে দাঁত খিঁচিয়ে উঠে সোরাবিয়া জিজ্ঞাসা করে, তুই? তোর গলার আওয়াজ শুনলাম? তুই হাঁকলি খবরদার!
হ্যাঁ, আমিই হাঁকলাম। ফেলিপিলিওর গলা এখন আর তীক্ষ্ণ তীব্র নয়। এ প্রতিবাদের পরিণাম জেনে সে শান্ত দৃঢ় স্বরে বলে, আগেই আপনাকে মানা করেছিলাম, মার্কুইস। তা সত্ত্বেও জোর করে আমায় এখানে এনে ভালো করেননি। এ পবিত্র প্রেত-প্রাসাদের রক্ষীরা এখন নেই। কিন্তু আমি আছি। এখানকার অগুনতি সোনা রুপোর দামি জিনিসের মধ্যে দু-চারটে নিতে চান তো নিন। আমি আপত্তি করব না। কিন্তু ইংকা-শ্রেষ্ঠ হুয়াইনা কাপাক-এর পবিত্র শবদেহ স্পর্শ করতে বা তাঁর সিংহাসন এখান থেকে সরিয়ে নিয়ে যেতে আপনি পারবেন না। অন্তত আমার মৃতদেহ না মাড়িয়ে নয়।
তোর মৃতদেহ না মাড়িয়ে? ফেলিপিলিওর কথাগুলো শুনতে শুনতে সোরাবিয়ার মুখে রাগের বদলে একটা ক্রুর পৈশাচিক হাসি এবার দেখা যায়। বেশ চিবিয়ে চিবিয়ে সে বলে, পাপোশ হবার তোর এত শখ তা আগে জানালেই পারতিস। যাক, এখন জানিয়েও ভাল করেছিস। তোর শখ আর আমার সাধ এক সঙ্গেই মিটিয়ে ফেলি, আয়।
সোরাবিয়া বাঁদর নাচাবার মতো অবজ্ঞার ভঙ্গিতে তলোয়ারটা নাড়ে ফেলিপিলিওর মুখের কাছে।
ফেলিপিলিও সরে যায়, কিন্তু ভয় পায় না। চরম নিয়তির জন্যে প্রস্তুত হয়েই সে মরণপণ করে মার্কুইসকে আক্রমণই করে।
তার আক্রমণে বেপরোয়া সাহসই আছে, কিন্তু তাতে নেহাত অক্ষম অজ্ঞ আনাড়ির আড়ষ্টতা নিতান্ত স্পষ্ট। সোরাবিয়ার হিংস্র কৌতুক তাতে আরও তীব্র হয়।
এক আঘাতে এফোঁড়-ওফোঁড় নয়, একটু একটু করে ফেলিপিলিওর গায়ে এখানে ওখানে তলোয়ারের ডগা বিঁধিয়ে রক্তপাত করে সোরাবিয়া তাকে ধীরে ধীরে মারবার নির্মম আনন্দটাই উপভোগ করে।
হঠাৎ আবার সেই অশরীরি ধ্বনি—এখনও ক্ষান্ত হও সোরাবিয়া। অক্ষম দুর্বলকে মৃত্যুযন্ত্রণা দিয়ে আনন্দ পাওয়ার দ্বিগুণ দাম তা হলে তোমায় দিতে হবে। এখনও বলছি, এ প্রেত-প্রাসাদ ছেড়ে চলে যাও। জেনে রাখো ফেলিপিলিও আমার আশ্রিত–