একজন মশালচি সেপাই-এর হাত থেকে একটা মশাল টেনে নিয়ে ফেলিপিলিওর দিকে ছুঁড়ে দিয়ে সোরাবিয়া এগিয়ে গেছে পাহাড়ের গায়ে বসানো দরজার দিকে।
কিছুক্ষণ আগেই এসপানিওল সৈনিকেরা সেখান দিয়ে ছুটে পালিয়ে এসেছে। তাদের ধাক্কায় দরজাটা খোলাই ছিল। পেছন থেকে ফেলিপিলিওর হাতের মশালের আলো তখনও তো এসে পড়েনি। ভেতরটা পাহাড়টারই যেন বিরাট অন্ধকার মুখের হাঁ বলে মনে হচ্ছিল।
মশালের লালচে কাঁপা আলো পড়ায় সে অন্ধকার গভীর গহ্বরের চেহারাটা বদলে গেলেও থমথমে রহস্যের ভাবটা আরও যেন গাঢ় হয়েছে।
সোরাবিয়া নিজের একটা ভুল তখন মনে মনে নিজের কাছে স্বীকার করেছে। রাগের মাথায় সওয়ার সৈনিকদের গালাগাল দিতে গিয়ে তারা কী এখানে দেখেছে তা জিজ্ঞাসা করা হয়নি।
ফেলিপিলিওকে এখন অবশ্য জিঞ্জাসা করা যায়। কিন্তু একজন এসপানিওল আর এদেশের কুসংস্কারে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়ানো একজন জংলির দেখা তো এক নয়। ওপরে একটু-আধটু পালিশ হলেও ফেলিপিলিও মনে-প্রাণে এখনও এদেশের মুখখু গোঁড়া জংলি। সে যদি কিছু দেখে থাকে তো চোখের চেয়ে মনের কল্পনাতেই দেখেছে। তার কথার কোনও দাম নেই তাই। এসপানিওল সৈনিকদের কাউকেই জিজ্ঞেস করে আসা উচিত ছিল বলে বুঝেছে সোরাবিয়া।
ভেতরের বিরাট গুহাকক্ষের ভেতর এগিয়ে যেতে যেতে মশালের আলোয় সোরাবিয়া যা এখন দেখেছে তা সত্যিই চোখ ধাঁধিয়ে দেবার মত। সূর্যবরণ প্রান্তরের শবসভায় এ ঐশ্বর্য আড়ম্বরের এক শতাংশও নিয়ে গিয়ে দেখানো হয়নি। তা সম্ভবও নয়।
যে ঐশ্বর্য এখানে জমা হয়ে আছে সোরাবিয়া আর হেরাদার সঙ্গে যারা এসেছে। সেই গোটা এসপানিওল সওয়ার বাহিনীর তাতে এক জন্মের মতো লুঠের সাধ মিটে যায়।
আর যে আহাম্মকগুলো এখানে এসেছিল তারা কি না মেয়েছেলের মতো কোথায় কী ছায়া নড়তে দেখে এসপানিওল বীরত্বের মুখে চুনকালি মাখিয়ে ছুটে পালিয়েছে।
এই তো বিরাট গুহাপুরী। মশালের আলো যতুটুকু পৌঁছোচ্ছে তার বাইরে ফিকে থেকে ক্রমশ গাঢ় হওয়া অন্ধকারের একটা বেড় যেন একটু অসাবধান হলেই চেপে ধরবার জন্যে ওত পেতে আছে মনে করা যেতে পারে, কিন্তু সে তো নেহাত অলীক কল্পনা।
এক মশালের আলোর শিখাটা বাদে গুহাপুরীতে যত কিছু সব নিথর নিস্পন্দ। তাদের নিজেদের পায়ের আওয়াজটুকু ছাড়া চারিদিকে তাদের ঘিরে গভীর নিস্তব্ধতা।
মশালের আলোর কম্পিত শিখার ছায়ায় শুধু মাঝে মাঝে যেন চোখের ভুল একটু ঘটছে।
ঠিক আগের মুহূর্তেই রাজবেশ পরিয়ে সোনার সিংহাসনে বসানো ইংকা নরেশের শবদেহটা কেমন একটু যেন নড়ে বসল বলে মনে হয়েছিল।
দৃষ্টিবিভ্রম ছাড়া তা আর কী হতে পারে!
জোরের সঙ্গে নিজেকে একথা বোঝাতে গিয়েই সোরাবিয়ার শিরদাঁড়ার ভেতর দিয়ে একটা বরফের ধারা নেমে গিয়ে সমস্ত শরীরে কাঁটা দিয়ে উঠেছে।
ফিসফিস করে কে যেন কী বলছে। না, ফেলিপিলিও নয়। সোরাবিয়া তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকে লক্ষ করেছে। ফিসফিস করে বলার ভাষাটা কিন্তু নিখুঁত কাস্তিলিয়ান। আর যা বলছে তার মানে হল, ফিরে যাও সোরাবিয়া। এ প্রেত-প্রাসাদ অপবিত্র করে আমার
অভিশাপ সাধ করে মাথায় নিও না।
ফেলিপিলিও তো নির্বাক। তা হলে এ অশরীরী ঘোষণা কোথা থেকে আসছে?
এ ঘোষণার ভাষা আবার কাস্তিলিয়ান! তা কী করে সম্ভব হয়? কাস্তিলিয়ান বলবার মতো মানুষ প্রেত-প্রাসাদে এক সোরাবিয়া নিজে আর ফেলিপিলিও।
ফেলিপিলিওর গলার স্বর তার চেনা। তা ছাড়া দোভাষী হিসেবে কাস্তিলিয়ান দিয়ে কাজ সারতে পারলেও তার ভাষায় উচ্চারণে অনেক ভুল।
আর এ তো একেবারে চোস্ত কাস্তিলিয়ান। স্পেনের রাজদরবারে শিক্ষিত বড় ঘরোয়ানারা যা ব্যবহার করে তা-ই!
সারাবিয়া মনে মনে জানে মূর্খ বলে এ নির্ভুল উচ্চারণের ভাষা তার গলা দিয়েও বার হয় না।
এ তা হলে সত্যিই কি ভৌতিক কিছু? অশরীরী দৈববাণী গোছের বলেই যে-ভাষায়-খুশি উচ্চারিত হতে পারে? সোরাবিয়া সারা শরীরে লোমহর্ষ নিয়ে কম্পিত বুকে চারিদিকে চেয়েছে। ফেলিপিলিওর দিকে চোখ পড়েছে তাইতেই। সমস্ত মুখ তার আতঙ্কে রক্তশূন্য হয়ে গেছে, চোখের দৃষ্টি উভ্রান্ত।
তার অসাড় হাত থেকে মশালটা পড়ে গিয়ে একটা অগ্নিকাণ্ডই বুঝি বাধাত এই প্রেত-প্রাসাদের দাউ দাউ করে জ্বলবার নানা উপকরণের মধ্যে।
সোরাবিয়া তাড়াতাড়ি সেটা ফেলিপিলিওর হাত থেকে কেড়ে নিয়ে মেঝের উপর রাখা একটা সরু গলার দীর্ঘ ভৃঙ্গার গোছের রুপোর পাত্রের মুখে বসিয়ে দিয়েছে।
ফেলিপিলিও তখন অর্ধচেতন অবস্থায় সেই ভৃঙ্গারের পাশেই দেওয়ালে ঠেস দিয়ে কোনওরকমে নিজেকে সামলাবার চেষ্টা করছে।
সে ভৌতিক ঘোষণা এখন থেমে গেছে।
কী করবে সোরাবিয়া?
মানে মানে পালিয়েই যাবে এই অভিশপ্ত প্রেত-প্রাসাদ থেকে? এখন যদি চলে যায় বাইরের তার সওয়ার সৈনিকেরা কেউ সন্দেহ করতে পারবে না যে ভয় পেয়ে সে পালিয়ে এসেছে।
শুধু ফেলিপিলিও থাকবে একমাত্র সাক্ষী! কিন্তু ফেলিপিলিও নিজেই কী হয়েছে। ভাল করে মনে করতে পারবে কি? তা ছাড়া নিজের ভয়ের লজ্জা ঢাকতেই তাকে নীরব থাকতে হবে।
পিছু হটে পালাবার জন্যে পেছনে পা বাড়াতে গিয়ে একটা কথাই সোরাবিয়া এই আতঙ্কের মধ্যেও ভুলতে পারে না। এরকম ভাবে পালালে একটা আফশোশই তার থেকে যাবে। অনুচর সেপাইদের কাছে কৈফিয়তটাও খুব জোরদার হবে না যদি একেবারে শুধু হাতে সে ফেরে!