সেপাইরা নিজেরা যা খুশি নিতে চায় নিক, তার জন্যে শুধু সিংহাসনটা নিয়ে আসা চাই-ই।
যা খুঁজছে সে জায়গা যদি না হয় তা হলে সোনার সিংহাসন গোছের কিছু না থাকলে সোরাবিয়ার জন্যে আনার দরকার নেই। সেপাইরা যা চায় নিজেরা লুঠ করে আনুক।
সেপাইদের সঙ্গে সোরাবিয়া ফেলিপিলিওকে পাঠিয়েছে। মৃত ইংকা নরেশদের প্রেত-প্রাসাদে যার-তার ঢোকবার অধিকার নেই। সেখানে যাওয়া তাদের ধর্মে বারণ বলে ফেলিপিলিও আপত্তি করবার চেষ্টা করেছিল। কিন্তু সোরাবিয়া কোনও ওজর আপত্তি শোনেনি।
অত্যন্ত নির্মমভাবে বিদ্রূপ করে বলেছে, মাথাই নেই তার মাথাব্যথা। তোদের দেবতারাই সব আমাদের ভয়ে দেশ ছেড়ে পালিয়েছে, এখন আবার তোদের ধর্ম কীসের? এদের সব দেখিয়ে শুনিয়ে বুঝিয়ে দিতে তুই না গেলে যাবে কে!
বাধ্য হয়ে যেতে হয়েছে ফেলিপিলিওকে সেপাইদের সঙ্গে।
সওয়ার সেপাইরাও যে প্রেত-প্রাসাদ লুঠ করতে খুব উৎসুক তা মনে হয়নি!
ভেতরে লোভ যতই থাক, এই বিদঘুটে বেমক্কা জায়গায় পাহাড়ের ভেতরে কাটা অজানা প্রেতপুরীতে ঢুকতে তাদের ভয় হয়েছে অনেক বেশি।
কিছুটা লোভ, কিছুটা দলে ভারী থাকার ভরসা, আর খানিকটা দলপতির হুকুমের দরুন শেষ পর্যন্ত সাহস করে মশাল নিয়ে গুটি গুটি তারা দরজা ঠেলে ঢুকেছে।
দরজা তাদের ভাঙতে কি কষ্ট করে খুলতে হয়নি। আধ ভেজানো অবস্থায় খোলাই পেয়েছে।
সোরাবিয়া তখন ঘোড়া ছেড়ে নেমে বাকি সব সওয়ারদের জড়ো করে মশালের আলোয় একরকম ছোটখাটো দরবার বসিয়েছে। এই একদিনে কে কত কী লুঠ করতে পেরেছে তা জিজ্ঞাসাবাদ করবার দরকার।
দু-একজন মাত্র সবে তাদের কথা জানিয়েছে, এমন সময় সোরাবিয়া আর তার সঙ্গীদের শিউরে চমকে উঠে তাকাতে হয়েছে পাহাড়ের গায়ে বসানোে প্রেত-প্রাসাদের দরজার দিকে।
সেখান থেকে আধ ভেজানো দরজার ভেতর দিয়ে কজনের গলায় যেন ভীত চিৎকারের মতো আওয়াজ আর গণ্ডগোল শোনা গেছে।
সবিস্ময়ে দু-চার মুহূর্তের বেশি অপেক্ষা করতে হয়নি। পাহাড়ের গায়ে বসানো। দরজা দিয়ে হুড়মুড় করে পড়ি কি মরি অবস্থায় বেসামাল মশাল দিয়ে প্রায় নিজেদের পোশাকেই আগুন ধরিয়ে ফেলে এসপানিওল সওয়ার সেপাইরা ছুটে বেরিয়ে এসেছে।
কী, হল কী?যতখানি রাগ, অধৈর্য, ততখানি উদ্বেগ নিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞাসা করেছে সোরাবিয়া।
কারও মুখে কোনও কথাই নেই। দিনের আলো হলে দেখা যেত তাদের মুখ থেকে যেন সব রক্ত সরে গেছে। চেষ্টা করেও তারা খানিকক্ষণ গলায় আওয়াজ ফোটাতে পারেনি।
প্রথম জবাব ফেলিপিলিও-ই দিয়েছে।
বলেছে, এ পবিত্র প্রেত-প্রাসাদের অপমান করবার অধিকার যে কারও নেই। পেরুর ইংকাশ্রেষ্ঠ নিজে তা আমাদের বুঝিয়ে দিয়েছেন, মার্কুইস! আঁর আত্মা এখনও এ প্রেত-প্রাসাদ পাহারা দিচ্ছে আমরা স্বচক্ষে দেখে এসেছি।
রাগের মাথায় সোরাবিয়ার মুখে এসেছিল—তোমরা সব ল্যাজ গুটানো খেকি কুকুরের দল! কিন্তু শুধু একা ফেলিপিলিও তো নয়, অন্য এসপানিওল সেপাইদের কথা মনে রেখে তাকে জিভের রাশ টানতে হয়েছে।
তবু তীব্র স্বরে সে বলেছে, কবে মরে মমি হয়ে গেছে, সে বাঁদির বাচ্চার আত্মাকে তোমরা পাহারা দিতে দেখেছ? তোমরা তো সব ভীরু খরগোশের পাল। কাঁপতে কাঁপতে সব ভেতরে গিয়ে ঢুকেছ আর তারপর নিজেদের মশালের ছায়াই নড়তে দেখে ভূত বলে আঁতকে পালিয়ে এসেছ। তোমরা সব এসপানিওল বীর! সাগর ডিঙিয়ে এসেছ রাজ্য জয় করতে!
গালাগাল অনেক সামলে নিয়েছে সোরাবিয়া, কিন্তু রগচটা এসপানিওল সেপাইরা মার্কুইস আর সেই সঙ্গে দলপতির মান রাখতেও এতটা সহ্য করতে প্রস্তুত নয়।
বেয়াদবি জেনেও তাদের একজন এবার বেপরোয়া হয়ে বলেছে, আমরা তো খরগোশের পাল বটেই, মার্কুইস। আপনি সিংহ হয়ে নিজেই একবার দেখে আসুন না, আমরা ছায়া দেখে ভির্মি গেছি কি না!
কেউ এ খোঁচা না দিলেও সোরাবিয়া তাই দেখতে নিজেই যে যেত সে বিষয়ে সন্দেহ নেই। আর যা-ই হোক, শয়তানি একটা সাহসের আস্ফালন তার আছে।
সে সাহস সম্বন্ধে সন্দেহের ইঙ্গিতে রেগে আগুন হয়ে উঠেছে সোরাবিয়া। ঘৃণা আর অবজ্ঞায় গলাটা যতদূর সম্ভব তিক্ত করে বলেছে, তা নিজে না দেখে। তোমাদের কথাই মেনে নিয়ে এখান থেকে ফিরে যাব ভেবেছিলে! এখুনি আমি যাচ্ছি। একজন শুধু এসো আমার সঙ্গে মশাল নিয়ে।
সোরাবিয়াকে কয়েক পা এগিয়ে আবার দাঁড়িয়ে পড়তে হয়েছে। তার সঙ্গে মশাল নিয়ে যাবার জন্যে কেউ এগিয়ে আসেনি।
কই, কে আসছে মশাল নিয়ে? সোরাবিয়া চিৎকার করে জিজ্ঞাসা করেছে।
কারও কাছ থেকেই কোনও সাড়া পাওয়া যায়নি।
সোরাবিয়া দাম্ভিক স্বার্থপর গোঁয়ার, কিন্তু নির্বোধ মোটেই নয়। সেপাই-সওয়ারদের এ অবাধ্যতা এখনই শাসন করতে গেলে ব্যাপারটা বিশ্রী হয়ে দাঁড়িয়ে তার উদ্দেশ্যটাই পণ্ড হতে পারে।
সওয়ার সেপাইদের ছেড়ে দিয়ে তাই সোরাবিয়া এবার ফেলিপিলিওকে হুকুম করেছে, মশাল নিয়ে তার সঙ্গে থাকার জন্যে।
এ আদেশ আমায় করবেন না, মার্কুইস। নিষ্ফল জেনেও ফেলিপিলিও একবার শুধু তার বক্তব্যটা জানিয়েছে—এ প্রেত-প্রাসাদ অপবিত্র করার শাস্তি আমি তো পাবই, আপনিও তা হলে এ অভিশাপ থেকে রেহাই পাবেন না।
আমায় তোদের জুজুর ভয় দেখাচ্ছিস, বাঁদির বাচ্চা!—সোরাবিয়া তার খোলা তলোয়ারের ডগাটা দিয়ে ফেলিপিলিওর পিঠে একটা খোঁচা দিয়েছে—নেহাত দোভাষী হিসেবে তোকে দিয়ে এখনও কিছু করবার আছে। নইলে এই খোঁচাতে এফোঁড় ওফোঁড় করে তোকে তোর জুজুর কাছে বলি দিয়ে যেতাম। চল এখন।