সঙ্গে যা নিতে পেরেছিলেন তা একটা ছোরা আর তার চেয়েও যা দামি সেই একপ্রান্ত ফুটো করা পাথরের ছোট গোলা পরানো আশ্চর্য দড়ির অস্ত্র-বোলাস।
এই প্রেত-প্রাসাদে গোপনে আশ্রয় নেবার সময়ে পেরুবাসীর সাধারণ পোশাক বাদে সেই বোলাস আর ছোরাটাই সঙ্গে এনে লুকিয়ে রাখতে পেরেছিলেন। সেই লুকোনো সম্বল বার করে এনে বাইরে যাবার জন্যে ইংকা নরেশের রাজবেশ ছেড়ে সাধারণ পোশাক পরতে গিয়ে বাধা পেয়েছেন গানাদো!
বাইরে কীসের একটা গণ্ডগোল শুনতে পাওয়া যাচ্ছে।
প্রেত-প্রাসাদের এ এলাকা একান্ত নির্জন ও নিস্তব্ধ। এ দেশের কেউ এ এলাকার পবিত্র নির্জনতা ও স্তব্ধতা সহজে ভঙ্গ করে না।
এ ধরনের অস্বাভাবিক গোলমালে তাই বিস্মিত হয়ে গুপ্ত ছিদ্রপথে গানাদো বাইরে কী হচ্ছে দেখতে গেছেন।
যা দেখেছেন তাতে একটু অস্বস্তিই বোধ করেছেন।
এ সেই এসপানিওল সওয়ারদের নিরীহ নিরস্ত্র কুজকোবাসীদের তাড়া করে প্রথম প্রেত-প্রাসাদের খোঁজ পাওয়ার ঘটনা।
তখনও সন্ধ্যা ভাল করে নামেনি। বাইরের আলো ম্লান হয়ে এলেও তার মধ্যে এসপানিওল সওয়ারেরা যে একজন কুজকোবাসীকে ধরে পাহাড়ের গায়ে বসানোে প্রেত-প্রাসাদের দরজার রহস্য জানবার চেষ্টা করছে তা তিনি বুঝেছেন।
কুজকোবাসীর কাছে কিছু জানতে না পারলেও নিজেদের কৌতূহলে ও লুঠের লোভে সওয়ার সৈনিকরা দরজা ওধারে কী আছে সন্ধান করবার চেষ্টা করতে পারে বলে গানাদোর সন্দেহ হয়েছে।
সাধারণ এদেশি পোশাক তখন পরা হয়ে গিয়েছিল। লুঠেরা সওয়াররা হয়তো তখনই হানা দিতে পারে। পোশাক বদলাবার সময় সুতরাং আর নেই। সে ঝক্কি না নিয়ে গানাদো যা পরেছিলেন তারই ওপর ইংকা নরেশের শবদেহের রাজবেশ তাড়াতাড়ি চাপিয়ে রাজপালঙ্কে গিয়ে মমির মতো শয্যা নিয়েছেন।
সেপাইরা যদি কোনও কারণে সন্দেহ করে ইংকার শবদেহের রহস্য ধরে ফেলে তা হলে সে চরম সংকটে ব্যবহারের জন্যে হুয়াইনা কাপাক-এরই মণিমাণিক্যখচিত তলোয়ারটা শুধু লুকিয়ে রাখবার ব্যবস্থা করেছেন শয্যার ভেতরে।
সওয়ার সেপাইরা শেষ পর্যন্ত সাহস করে অবশ্য পাহাড়ের গায়ে বসানো রহস্যময় দরজা ঠেলে ভেতরে যেতে সাহস করেনি। কিছুক্ষণ বাদে বাইরে তাদের গোলমাল থেমে গেছে।
বিছানা ছেড়ে উঠে বসলেও গানাদো তবু নিশ্চিন্ত হয়ে প্রেত-প্রাসাদ ছেড়ে তখনই বার হওয়া সমীচীন মনে করেননি।
সওয়ার সৈনিকদের ভয়েই যে তিনি বার হতে দ্বিধা করেছেন তা নয়। দরকার হলে একসঙ্গে ও রকম কয়েকজন সওয়ারের মওড়া নেবার ক্ষমতা তিনি রাখেন।
কিন্তু এখন তাঁর যা উদ্দেশ্য তা সিদ্ধ করতে হলে সবার আগে দরকার সম্পূর্ণ গোপনতা।
বীরত্ব দেখাতে গিয়ে তাঁর পরিচয় জানাজানি হয়ে গেলে তিনি যা করতে চান তার সব আশা এখানেই নিমূল হয়ে যাবে।
ভীরুর মতোই অতি সাবধানে সওয়ার সৈনিকদের চোখে পড়বার বিপদ সম্পূর্ণ কেটে যাবার জন্যে ধৈর্য ধরে তিনি অপেক্ষা করেন। লুঠের নেশায় মত্ত এইসব পাষণ্ড এসপানিওলদের কোনও বিশ্বাস নেই। একবার ভয় পেয়ে এ অঞ্চল ছেড়ে গেলেও আবার দল ভারী করে খেয়ালের মাথায় এখানে হানা দিতে তারা আসতে পারে।
তখন তাদের সামনে পড়তে গানাদো চান না।
একটু বেশি রাত হবার জন্যে তাই তিনি অপেক্ষা করেন। রাতের অন্ধকারে সব। দিক দিয়েই তাঁর সুবিধে।
শুধু যে এসপানিওল সেনারা তখন খাবার আর সুরা নিয়ে মেতে থাকবে তা নয়, আঁধারে আঁধারে কুজকো ছেড়ে সৌসার পথে বেশ কিছুদূর এগিয়ে যাওয়াও তাঁর সহজ হবে।
গানাদো যা আশা করে অপেক্ষা করেছেন ঘটনা ঘটেছে ঠিক তার বিপরীত।
রাত গভীর হলে প্রেত-প্রাসাদ ছেড়ে বার হওয়া তাঁর পক্ষে নিরাপদ হবে ভেবেছিলেন গানাদো।
সেই অনুসারে রাত্রির প্রথম প্রহর শেষ হবার পর প্রেত-প্রাসাদের দরজা তিনি যখন খুলতে যাচ্ছেন হঠাৎ সেই মুহূর্তে সচকিত হয়ে উঠেছে চারিধারের নিস্তব্ধ অন্ধকার প্রান্তর লুব্ধ হিংস্র সওয়ার সৈনিকদের চিৎকারে আর ঘোড়ার পায়ের শব্দে। সেই সঙ্গে বহু মশালের কম্পিত শিখার আলো ঈষৎ খোলা দরজার ফাঁক দিয়ে যেন ভয়ংকর কোনও অশুভ সম্ভাবনার ছায়া কাঁপিয়েছে ভেতরের দেয়ালে।
২৮. সোরাবিয়া ফেলিপিলিও
সোরাবিয়া ফেলিপিলিও আর তার বাছাই করা সওয়ার দলকে নিয়ে পাহাড়ের গায়ে লুকোনো প্রেত-প্রাসাদের দরজায় এসে নিজেদের ঘোড়া রুখেছে।
জায়গাটা সত্যিই কেমন হানা দেওয়া কবরের রাজ্যের মতো।
মশালের আলোয় পাহাড়ের গায়ে বিরাট খোদাই করা দরজাটা না দেখলে এখানে কোনও লুকোনো পুরী আছে, সোরাবিয়া বিশ্বাসই করতে পারত না।
এখন এটাই হুয়াইনা কাপাক-এর প্রেত-প্রাসাদ কি না তা-ও জানবার কোনও উপায় নেই। ফেলিপিলিও এ বিষয়ে এসপানিওলদের মতোই অজ্ঞ দেখা গেছে। এদেশের ভাষাটা ছাড়া আর কিছুই সে জানে না।
হুয়াইনা কাপাক-এর হোক বা না হোক সন্ধান যখন পাওয়া গেছে তখন এ। প্রেত-প্রাসাদই একটু হাঁটকে না দেখে সোরাবিয়া যাবে না।
ছোটখাটো জিনিসে তার লোভ নেই। তার ভাবখানা হল মারি তো গণ্ডার লুঠি তো ভাণ্ডার।
সওয়ার সেপাইদের সেই মতোই হুকুম সে দিয়েছে। জন-চারেক মিলে মশাল। নিয়ে ভেতরে ঢুকে একবার দেখে আসুক। হুয়াইনা কাপাক-এর প্রেত-প্রাসাদ হলে সাজসজ্জার ঘটা আর ঐশ্বর্যের আড়ম্বর দেখেই বুঝতে পারবে। সূর্যবরণ প্রান্তরে অতক্ষণ ধরে দেখে হুয়াইনা কাপাক-এর রাজবেশটাও চেনা হয়ে গেছে।