সোরাবিয়া জায়গাটা কী হতে পারে একবার জিজ্ঞাসা করেছে ফেলিপিলিওকে।
ফেলিপিলিও মনে মনে প্রমাদ গুনলেও বাইরে কিছু বুঝতে দেয়নি। জায়গাটা পুরনো কালের কোনও সত্যি-সত্যি হানা দেওয়া ধ্বংসপুরীর অবশেষ বলে তুচ্ছই করে দিতে চেয়েছে।
কিন্তু সোরাবিয়া তার কথা মানেনি। ধ্বংসপুরী বা যাই হোক, সেই রাত্রেই নিজের বাছাই করা ক-জন সওয়ার সৈনিক নিয়ে মশাল জ্বেলে সে হানা দিতে বেরিয়েছে। সেই পাহাড়ে লুকোনো পুরীতে। সঙ্গে যেতে বাধ্য করেছে ফেলিপিলিওকে।
২৭. কী করছেন তখন গানাদো
কী করছেন তখন গানাদো? কোথায় তখন তিনি?
আর কোথাও নয়, হুয়াইনা কাপাক-এর প্রেত-প্রাসাদেই তখনও তিনি আছেন। আছেন নিজের ইচ্ছাতেই। কোনও কিছুর সঠিক খবর না পেয়ে এ অবস্থায় কী তাঁর করা উচিত তখনও স্থির করে উঠতে পারেননি বলেই প্রেত-প্রাসাদ ছেড়ে বার হতে তিনি দেরি করেছেন।
ইতিপূর্বে প্রেত-প্রাসাদ থেকে বার হওয়া খুব কঠিন হয়তো তাঁর পক্ষে হত না।
এসপানিওল সওয়ারদের চড়াও হওয়ার দরুন সূর্যবরণ প্রান্তর ফাঁকা হয়ে যাবার পরও হুয়াইনা কাপাক-এর রক্ষীরা কিছুক্ষণ সেখানে অপেক্ষা করেছে।
রেইমির উৎসবের সারা সপ্তাহের মধ্যে ইংকা নরেশের রাজবেশে সজ্জিত। শবদেহ সূর্যবরণ প্রান্তর থেকে সরাবার কোনও নজির তাদের ইতিহাসে নেই বলেই তারা যে কোনও মুহূর্তে শত্রুরা সব লুঠপাট করতে পারে বুঝেও শব-সভা ভেঙে প্রেত-প্রাসাদে ফিরে যেতে প্রথমটা চায়নি। কিন্তু কোথায় আর উৎসব!
রাজপুরোহিত ভিলিয়াক ভমুর দেখা নেই।
রেইমি উৎসবের যারা প্রধান পাণ্ডা কোরিকাঞ্চার সেই ছোট বড় পুরোহিতদেরও প্রান্তর ছেড়ে চলে যেতে দেখবার পর আর দ্বিধা না করে ইংকা নরেশের শবদেহের সঙ্গে শব-সভার আর সব উপকরণ সাজসজ্জা প্রেত-প্রাসাদে ফিরিয়ে নিয়ে যাবার ব্যবস্থা তারা করেছে।
গানাদো ইচ্ছে করলে সে সময়ে হয়তো নিজেকে মুক্ত করতে পারতেন।
কিন্তু ব্যাপারটা নিঃশব্দে সারা যেত না। হুয়াইনা কাপাক-এর নব জাগরণের কোনও তাৎপর্যও দেওয়া যেত না সে ঘটনায়। অস্বাভাবিক যে চাঞ্চল্য তাতে সৃষ্টি হত তাঁর নিজের উদ্দেশ্য সিদ্ধির তা বাধা হতে পারত।
গানাদো তাই শবদেহের মতোই নিথর নিস্পন্দ হয়ে হুয়াইনা কাপাক-এর রক্ষীদের তাঁকে ভক্তিভরে বয়ে নিয়ে যেতে দিয়েছেন।
নিথর নিস্পন্দ তিনি তখন অবশ্য শুধু দেহে। মনের ভেতরটা তুফানের সমুদ্রের চেয়ে অস্থির।
ঘটনা কোথায় কী ঘটেছে তার বিন্দুমাত্র আভাস না পাওয়ার জন্যেই তাঁর উদ্বেগ দুর্ভাবনা আরও বেশি। সত্যি কথা বলতে গেলে সব কিছুই এখন তাঁর কাছে হেঁয়ালি।
কামালকা থেকে এসপানিওল সওয়ার দল নিয়ে সোরাবিয়ার কুজকো পর্যন্ত হানা দেওয়ার লক্ষ্য যে তিনি, এটুকু বুঝলেও কেমন করে এমনসব যোগাযোগ সম্ভব হল তা তিনি ভেবে পাননি।
সৌসার খবরের জন্যেই তাঁর আকুলতা উদ্বেগ সবচেয়ে বেশি। কী হয়েছে সৌসায়? যেখান থেকে একটা বিস্ফোরণ সমস্ত পেরুকে কাঁপিয়ে তুলবে সে সৌসা হঠাৎ যেন পেরুর মানচিত্র থেকেই মুছে গেছে!
একটা সামান্য সাড়াশব্দও সেখান থেকে পাওয়া যাচ্ছে না। রাজপুরোহিত ভিলিয়াক ভূমু ব্যস্ত হয়ে সেখানে ছুটেছেন। সে ছোটার কারণটা অতি স্পষ্ট।
গানাদোকে ধরতে না পেরে আর কয়ারও কোনও সন্ধান না পেয়ে ক্ষিপ্ত হয়ে তিনি সৌসা ছুটে গেছেন হুয়াসকারকে মুক্ত করার সমস্ত আয়োজন পণ্ড করার জন্যে।
কিন্তু কয়া যদি সেখানে পৌঁছোতে পেরে থাকে তা হলে রাজপুরোহিতের সাধ্য কী যে গানাদোর সাজানো চাল এক চুল এদিক-ওদিক করেন।
কয়া অবশ্য যদি বিফল হয়ে থাকে—
ভাবতেই শিউরে ওঠেন গানাদো। কয়া বা ভিলিয়াক ভমু একজন তো সফল হবেই। হয় মুক্ত হুয়াসকার না হয় সাফল্যগর্বিত ভিলিয়াক ভমুকে তো দেখা যাবে কুজকোর সূর্য-বরণ প্রান্তরে রেইমি উৎসবের প্রথম শুভ লগ্নে?
রেইমি উৎসবের প্রথম দিনের সূর্য পশ্চিমে ড়ুবতে চলেছে, তবু সৌসা থেকে দুপক্ষের কারওই কোনও বার্তা এসে পৌঁছয়নি।
কী এমন সৌসায় ঘটে থাকতে পারে যা সেখানকার এই অদ্ভুত অস্বাভাবিক নীরবতা সম্ভব করে তুলেছে?
কয়ার ভাবনাতেই সবচেয়ে কাতর হয়ে ওঠেন গানাদো।
কন্যাশ্রমের অলঙ্ঘ্য প্রাচীরের আড়ালে সূর্যসেবিকারূপে বাইরের সংসারের সঙ্গে কোনও সাক্ষাৎ পরিচয় যার হয়নি সেই অবলা অসহায় সদ্যকৈশোর-পার-হওয়া একটি মেয়েকে তিনি অসাধ্যসাধন করতে পাঠিয়েছেন।
পাঠিয়ে অবশ্য উপায় ছিল না।
কিন্তু ব্যর্থ যদি সে হয়ে থাকে তা হলে যে অবস্থা তার হয়েছে তা তো শোচনীয় বললেও কিছুই বলা হয় না।
সে অবস্থা যদি তার হয়ে থাকে তা হলে প্রতিকারে কিছুই অবশ্য করা গানাদোর পক্ষে সম্ভব নয়। তবু নির্বিকার হয়ে এই কুজকো শহরে আটকে থাকার যন্ত্রণা যে অসহ্য।
সন্ধ্যার অন্ধকার নেমে আসবার আগেই প্রেত-প্রাসাদের প্রহরীরা ইংকা নরেশের শবদেহের সমস্ত পরিচর্যার ব্যবস্থা করে দিয়ে বিদায় নিয়েছে। একজন প্রহরীর রাত্রের জন্যও এ প্রাসাদদ্বারে উপস্থিত থাকবার কথা। কিন্তু এ নিয়ম নিষ্প্রয়োজন বলেই আর পালিত হয় না।
গানাদো প্রেত-প্রাসাদ থেকে বার হবার জন্যে তৈরি হয়েছেন। তৈরি হবার আর কী আছে? এ প্রেত-প্রাসাদে লটবহর নিয়ে তো আর ঢুকতে পারেননি। কাক্সামালকা থেকে বার হবার সময়ই এসপানিওল সৈনিকের ধড়াচূড়ার সঙ্গে খাপে-ভরা তলোয়ারও সেখানে ফেলে আসতে হয়েছে।