এত কী বক বক করছিস, মর্কট? ফেলিপিলিওর দীর্ঘ বক্তৃতা পছন্দ হয়নি সোরাবিয়ার, দাঁত খিঁচিয়ে বলেছে, যা বলেছি তা বোঝাতে অত কথা কীসের!
ফেলিপিলিও বিনীতভাবে জানিয়েছে যে ভাল করে না বোঝালে ওরা যে ঠিক ববাঝে না। তা ছাড়া মার্কুইস যে কত বড় একজন রাজাগজা গোছের মানুষ, ইচ্ছে করলে ওদের সব ক-টার মাথা যে কেটে নিতে পারেন, তা-ই ওদের বোঝাতেই অত কথা বলতে হচ্ছিল।
তা অত বোঝাবার পরও ওদের মুখে রা নেই কেন? ফেলিপিলিওর কৈফিয়তেও ঠাণ্ডা না হয়ে বলেছে সোরাবিয়া, সব কি বোবা নাকি?
বোবা যে নয় তার প্রমাণ দিয়েছে এবার পুরুতদের একজন। এতক্ষণে নিজেদের খানিকটা সামলাতে পেরে একজন মুখ খুলেছে।
মুখ খুলে ফেলিপিলিও যা বলেছিল সেই মতো সোরাবিয়ার বাপান্ত অবশ্য সে করেনি। হাজার হলেও কোরিকাঞ্চার সমর্পিত সেবায়েত হিসেবে অত বড় প্রতিহিংসার জ্বালাতেও ইতরতায় নামা তাদের পক্ষে সহজ নয়।
পুরোহিত তাই শুধু দেবাদিদেব ভীরাকোচার নাম নিয়েই বলেছে যে, এ রাজ্যে দেবতা ও পূর্বপুরুষদের নামে উৎসর্গ করা পবিত্র সম্পদের দিকে নোংরা লোভের হাত যে বাড়াবে স্বয়ং আদিদেব ভীরাকোচাই তার উপযুক্ত শাস্তির ব্যবস্থা করবেন।
কী বলছে কী, বাঁদির বাচ্চাটা? হদিস কিছু দিচ্ছে? চড়া গলায় হলেও একটু উৎসুক হয়েই জিজ্ঞাসা করেছে সোরাবিয়া।
আজ্ঞে হ্যাঁ, মার্কুইস। ওরা যেমন জানে সেই হদিসই দিচ্ছে? বলে ফেলিপিলিও সোরাবিয়ার লালচটা আর একটু উসকে দিয়েছে।
কী হদিস দিচ্ছে? বেশ অধীর হয়েই জানতে চেয়েছে সোরাবিয়া।
আজ্ঞে, বলছে যে ওসব লুকোনো প্রেত-প্রাসাদের হদিস পাওয়া নাকি শক্ত নয়। বিনীত মোলায়েম গলায় বলেছে ফেলিপিলিও, শুধু বেঁচে থাকতে তা পাওয়ার উপায় নেই।
তা-ই বলছে! রাগে ফেটে পড়েছে সোরাবিয়া—ওদের সবাইকে সেই হদিস পেতেই আমি পাঠাচ্ছি। কোরিকাঞ্চার এই মন্দিরে সব কটাকে আমরা গলায় ফাঁসি দিয়ে ঝোলাব!
ওই হম্বিতম্বিই সার অবশ্য। চড়-চাপড় লাথি-ঘুষির বেশি চালাতে সাহস করেনি সোরাবিয়া। পিজারোর নেকনজরে থাকবার মতলবেই নিজেকে সামলানো তার সুবুদ্ধির পরিচয় বলে মনে হয়েছে।
সোনার সিংহাসনের লোভে প্রেত-প্রাসাদ খোঁজার চেষ্টা কিন্তু সে ছাড়েনি। ফেলিপিলিও তাকে এ খোঁজায় শেষ পর্যন্ত অক্লান্তভাবে যে ধরনের সাহায্য করে গেছে তার নমুনা আগেই পাওয়া গেছে কোরিকাঞ্চার মন্দিরে।
না গানাদোর সন্ধান, না তার অত লোভের সোনার সিংহাসন যেখানে রাখা সেই হুয়াইনা কাপাস-এর প্রেত-প্রাসাদের হদিস, কিছুই না পেয়ে বিফল হয়েই সোরাবিয়ার আবার এসপানিওল রিসালা নিয়ে কামালকায় ফিরে যাওয়ার কথা।
সঙ্গী হেরাদাকে সূর্যবরণ প্রান্তরের প্রথম ঘটনার পর কারা দুর্গ সৌসার দিকে সে। পাঠিয়েছিল, কিন্তু হেরাদা সন্ধ্যা হবার আগেই সে যাওয়া বাতিল করে তাঁবেদার সওয়ারদের নিয়ে কুজকোতেই ফিরে এসেছে।
কোনও কারণেই ভাগ হয়ে এসপানিওল রিসালা যেন নিজেদের দুর্বল না করে, সব সময়ে সর্বত্র যেন তারা একসঙ্গে থাকে, কুজকো রওনা হবার সময় সেনাপতি পিজারোর এই নির্দেশের কথা মনে করেই ফিরে আসতে বাধ্য হয়েছে হেরাদা।
সন্ধ্যাবেলা জোর করে দখল করা কোরিকাঞ্চার এক অতিথিশালায় দুই দলপতির আলাপ হয়েছে এর পর তাদের গতিবিধি কী হবে তাই নিয়ে।
গানাদোর কোনও খোঁজ পাওয়া যায়নি। কুজকোর রাজপুরোহিত ভিলিয়াক ভুমুরও কোনও পাত্তা নেই। এ শহরের লোকেরা এসপানিওলদের ভয়ে কাঠ! তারা এসপানিওল সওয়ার সৈনিকদের তুলনায় নিরস্ত্র অসহায় বললেই হয়। তবু সামান্য সেনাদল নিয়ে চারিধারে এ দেশের মানুষের চাপা ঘৃণা হিংসায় ঘেরা হয়ে বেশিদিন তাদের আসল ঘাঁটি কামালকা থেকে এতদূর শহরে থাকা নিরাপদ হবে বলে মনে হয়নি হেরাদার। সে পরের দিন সকালেই সওয়ার বাহিনী নিয়ে কামালকায় ফিরে যাবার পরামর্শ দিয়েছে। সোরাবিয়াকে অনিচ্ছা সত্ত্বেও মেনে নিতে হয়েছে সে। পরামর্শ।
সওয়ার সেনাদের কাছে হুকুম চলে গেছে পরের দিন ভোরেই ফিরে যাবার জন্যে তৈরি হবার।
সুতরাং সকল দিক দিয়ে নিষ্ফল সোরাবিয়ার এ অভিযানের ওপর এখানেই যবনিকা পড়বে এ কথাই ভাবা স্বাভাবিক।
কিন্তু নিয়তির নির্দেশ আলাদা। যে শয়তানি বুদ্ধি আর ভাগ্য মেক্সিকোয় কর্টেজ-এর বাহিনীর দল-খেদানো, মান-খোয়ানো এক সামান্য হিড্যালগো জুয়াড়িকে এক লাফে এসপানিয়ার মার্কুইস হবার সুযোগ করে দিয়েছে সেই ভাগ্যই কোন গৃঢ় উদ্দেশ্যে কে জানে এখানেও নিজের হাতে যেন শেষ মুহূর্তে ঘটনার খুঁটি নেড়েছে।
যা সে খুঁজছে সেই গোপন প্রেত-প্রাসাদের হদিস অপ্রত্যাশিতভাবে মিলে গেছে। সোরাবিয়ার। হদিস মিলেছে ছোট একদল এসপানিওল দলের কাছে। তারা যথারীতি লুঠতরাজের ধান্দায় সারাদিন কাটিয়ে সন্ধ্যায় ফৌজি আস্তানায় ফিরছিল। তখন সন্ধে হয়ে গেছে। শহরের একটু বাইরে পাহাড়ি দুর্গম একটা রাস্তায় একদল কুজকোবাসীকে আসতে দেখে তারা তাড়া করে। তাড়া করতে গিয়ে একটি পাহাড়ি বাঁক ঘুরে দূরে খাড়া একটা পাহাড়ের গায়ে যেন কেটে লাগানো একটা দরজা গোছের তারা দেখতে পায়। যে কুজকোবাসীদের কতকটা মজা করেই তারা তাড়া করেছিল, তাদের সবাই তখন এদিকে-ওদিকে পালিয়ে গেছে। এসপানিওলদের হাতে ধরা পড়েছিল শুধু একজন। ভাষা কেউ কারও জানে না। তবু ইশারা ইঙ্গিতে জায়গাটা কী তাকে জিজ্ঞেস করা হয়। হিজিবিজি যা সে বলে তা বুঝতে না পেরে তাকে সেদিকে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করা হয় তারপর। সে চেষ্টায় লোকটার মুখ চোখ যা হয় তাতে জায়গাটা ভয়ংকর কিছু বলেই এসপানিওল সওয়ার দলের ধারণা হয়েছে। লোকটা সেদিকে যেতে তো চায়ইনি, তাদের জুলুমে এমনভাবে ভূমিশয্যা নিয়েছে যে মেরে ফেললে যেন তাকে আর ওদিকে নড়ানো যাবে না। তখন সন্ধের অন্ধকার ঘনিয়ে আসছে। লোকটার ব্যাপার দেখে শুনে এসপানিওলদেরও কেমন গা ছমছম করেছে জায়গাটায়। ভরসা করে রাত্রে তাই সেদিকে আর এগোয়নি। ইচ্ছে ছিল পরের দিন দিনের আলোয় একবার হানা দিয়ে দেখবে কিন্তু তা তো আর হবার নয়।