না জানো তো জিজ্ঞেস করো এই বাঁদির বাচ্চাদের কাউকে! হুকুম করেছে সোরাবিয়া।
জিজ্ঞেস কাকে করব? যেন হতাশ হয়ে বলেছে ফেলিপিলিও, আমাদের একশো হাত দূর থেকে দেখলে এরা পালাচ্ছে। যদি বা কাউকে ধরতে পারা যায় সে কি কিছু বলতে পারবে! ইংকাদের প্রেত-প্রাসাদ তো একটা নয়! বেশির ভাগই সেসব আবার এমন লুকোনো যে নিজস্ব অনুচরেরা ছাড়া তার সন্ধান কেউ জানে না। এক ভিলিয়াক ভূমুর নিজের গোপন কিপুর গোছায় ছাড়া কোথাও তাদের হদিস মেলবার নয়। ভিলিয়াক ভমু তো আবার এখানে নেই।
তোর বক্তৃতা শুনতে এখানে আসিনি, বেইমান মর্কট! সোরাবিয়া প্রচণ্ড এক চড় মেরেছে ফেলিপিলিওর গালে। তারপর হিংস্রভাবে বলেছে, যেমন করে পারিস সে জায়গার হদিস জোগাড় কর। সে সিংহাসন আমার চাই। যে আজ্ঞে মার্কুইস! সসম্রমে বলেছে ফেলিপিলিও।
হ্যাঁ, ফেলিপিলিও যেমন করে পারে সে জায়গার হদিস জোগাড় করার প্রাণপণ চেষ্টা করেছে বটে।
সোরাবিয়া নিজের চোখে তা দেখেছে।
ফেলিপিলিও পাছে খোঁজায় ঢিল দেয় সেই সন্দেহে তার সঙ্গে সঙ্গে থেকেছে। সোরাবিয়া। ফেলিপিলিও তাতে অস্বস্তিবোধ করবার বদলে সত্যিই যেন খুশি। খুশি বোধহয় তার আন্তরিকতা দেখাবার সুযোগ পাবার দরুন!
কী আন্তরিকতাই না দেখা গেছে ফেলিপিলিওর! সোরাবিয়ার চড় খেয়েই তার গরজ, তার আন্তরিক আগ্রহ যেন বেড়ে গেছে!
কারও কাছে খোঁজ নিতে সে বাকি রাখেনি। অন্তত নাগালের মধ্যে যাদের পাওয়া গেছে তাদের প্রত্যেকের কাছে।
প্রথমেই নাগালের মধ্যে পাওয়া গেছে কোরিকাঞ্চার ছোট পুরুতদের। কুজকো শহরের লোক এই দিনটির আগে পর্যন্ত স্বচক্ষে তাদের রাজ্যে হানাদার কোনও সাদা বিদেশি দেখেনি।
শুধু গুজব শুনেছে তাদের সম্বন্ধে।
গুজব সাধারণত সত্যের চেয়ে অনেক ফাঁপানোই হয়। কিন্তু ভোর থেকে বেলা দুপুরের মধ্যেই কুজকোবাসীদের এসপানিওল হানাদারদের সঙ্গে যেটুকু পরিচয় হয়েছে তাতে তাদের মনে হয়েছে, গুজব বুঝি সত্যের তুলনায় অনেক ফিকে।
এসপানিওলরা যা দেখেছে, যা পেয়েছে, লুঠপাট তো করেইছে, দেবস্থান থেকে শুরু করে কোনও কিছুরই মান আর রাখেনি।
এসপানিওলদের নামেই কুজকোর যে যেখানে পেরেছে পালিয়ে বাঁচবার চেষ্টা করেছে, কিন্তু তাদের মধ্যে সওয়ার সেনাদের হাতে ধরাও পড়েছে অনেকে। যারা ধরা পড়েছে তাদের লাঞ্ছনার আর সীমা থাকেনি, বিশেষ করে মেয়েদের। তাদের যা হয়েছে তা মৃত্যুর অধিক।
এ সব কিছুর খবরই কোরিকাঞ্চার ছোট পুরুতদের কানে এসেছে, তারা চোখেও দেখেছে অনেক কিছু।
আর সবাই পালাবার চেষ্টা করলেও তাদের সে উপায় নেই। প্রাণের মায়া ত্যাগ করে মন্দিরে দেবতার সম্মানে তাদের থাকতে হয়েছে।
তাই তাদের কাছেই ফেলিপিলিওর খোঁজ নেবার প্রথম সুযোগ হয়েছে। সে সুযোগের পুরো সদ্ব্যবহার করেছে ফেলিপিলিও।
সোরাবিয়ার হুকুমে বলির পাঁঠার মতো কোরিকাঞ্চার পুরুতদের তখন দাঁড় করানো হয়েছে ভেতরের চত্বরে।
ফেলিপিলিও সোরাবিয়ারই উপযুক্ত প্রতিনিধির মতো মুখের চেহারা আর গলায় তাদের কুইচুয়া ভাষায় তার প্রশ্ন জানিয়েছে।
কিন্তু সে প্রশ্ন শুনে তাদের মুখগুলো হঠাৎ অমন হয়ে গিয়েছে কেন? প্রাণের ভয়ে মানের ভয়ে দাঁড়াবার মতো পায়ের জোর না পেয়ে, বুক যাদের কাঁপছে তাদের মুখের অমন অদ্ভুত চেহারা হয়ে গেল কীসে?
সোরাবিয়ার সেটা লক্ষ এড়ায়নি। তার কাছে এ দেশের মর্কটদের মুখের ভাবটাবের কোনও অর্থই নেই। তবু একটু খটকা তার লেগেছে। নিজের দেশের মানুষ। হলে এ ধরনের মুখের ভাব যেন কাঁদতে গিয়ে হাসি চাপার বলেই তার মনে হত।
পুরুতদের মুখগুলো এই রকম অদ্ভুত হয়ে গেলেও জবাব কেউ দেয়নি। দেবার ক্ষমতাই তাদের নেই।
কী প্রশ্ন তা হলে করেছে তাদের ফেলিপিনিও!
প্রশ্ন বড় জবর। চোস্ত কুইচুয়া ভাষায় ফেলিপিলিও জিজ্ঞাসা করেছে, এই যে সাদা চামড়ার জানোয়ারটা মানুষের পোশাকে সেজে আমার পাশে দাঁড়িয়ে আছে, সে কী চায় জানো? সে আমাদের দেবতাদের সব ধনদৌলত লুঠ করতে চায়। দেবে তোমরা সে সবের সন্ধান?
প্রথমটা এসপানিওল শত্রুদের কাছে নিজেকে বিকোনো এক দেশদ্রোহীর মুখে এরকম অপ্রত্যাশিত কথা শুনে তারা হতভম্ব হয়ে গিয়েছে। ফেলিপিলিও যে সত্যিই তার মনিবদের অমন করে গাল পাড়বে তা বিশ্বাস করাই শক্ত হয়েছে তাদের পক্ষে। একটু সন্দেহ হয়েছে, ফেলিপিলিও হয়তো তাদের পরীক্ষা করছে কি না এমনই করে! সন্দেহটা টেকেনি। তার বদলে ব্যাপারটার মধ্যে যে মজা আছে সেইটেই বড় হয়ে উঠেছে। শুধু ফেলিপিলিওর পাশে তার মনিবের দুশমনি চেহারা দেখেই কোনওরকমে মুখে হাসি তারা সামলেছে।
ফেলিপিলিও সম্বন্ধে যেটুকু সন্দেহ ছিল তা কেটে গেছে তার পরের কথায়।
ফেলিপিলিও মুখোনা আগের মতোই হিংস্র করে রেখে বলেছে, একেবারে চুপ করে থাকলে সাদা জানোয়ারটা সন্দেহ করবে। তোমরা দু-একজন অন্তত মাথাটা নাড়ো।
তাই নেড়েছে দু-একজন।
ফেলিপিলিও যেন হতাশভাবে সোরাবিয়ার দিকে ফিরে কাতর স্বরে বলেছে, দেখলেন তো মার্কুইস, ওরা কিছুই জানে না বলছে!
বলছে শয়তানি করে! গর্জন করে উঠেছে সোরাবিয়া, তলপেটে দুটো লাথি দিলেই কিছু জানে কি না বোঝা যাবে! ওদের বলো যে মড়ার কবরখানা কোথায় এখনই না বললে তলোয়ার খুঁজে গলার ছিদ্রগুলো বড় করে দেব।
তাই বলছি, মার্কুইস! সসম্রমে মার্কুইসের হুকুম শুনে ফেলিপিলিও পুরুতদের দিকে ফিরে ধমকের সুরে বলেছে, সাদা শকুনটা কী বলে, জানো! পবিত্র একটা নাম পাষণ্ডটার নোংরা পচা মুখে উচ্চারিত হওয়া চাই না বলেই একটু ঘুরিয়ে বলছি। পাষণ্ডটা বলছে—আমাদের পরম পূজনীয় সাবেকি ইংকাশ্রেষ্ঠের প্রেত-প্রাসাদের খবর না দিলে তোমাদের সকলের গলার ছিদ্র তলোয়ারের ফলায় বড় করে দেবে! জানোয়ারটার হুমকি শুনে ভয় পেয়ো না। আর যাই হোক, বিদেশি শয়তানদের ও সর্দার নয়, যাকে খুশি কোতল করবার এক্তিয়ার নিয়েও আসেনি। অন্যায় জুলুমবাজি যার তার ওপর করলে ওকেও জবাবদিহি দিতে হবে। ওর হম্বিতম্বির জবাবে মাথা নেড়ে আমাদের ভাষায় শুধু ওকে যা পারো বাপান্ত করে নাও। আমি ওকে জল বুঝিয়ে দেব!