পিজারোকে নিজের ধারণার কথা এবার জোরের সঙ্গে জানিয়েছে মার্কুইস। পিজারোর কাছে ছোট একটা রিসালা নিয়ে কুজকো শহরে গিয়ে গানাদোকে ধরবার অনুমতিও সে আদায় করেছে।
পিজারো দোভাষী হিসেবে ফেলিপিলিও আর এ রাজ্যের অভিজ্ঞ সৈন্যাধ্যক্ষ হিসেবে হেরাদাকে মার্কুইস-এর সঙ্গে দিয়েছেন, আর সেই সঙ্গে ফেলিপিলিওর হাতে রাজপুরোহিত ভিলিয়াক ভমুকে নিজের শিলমোহর মারা আদেশও দিয়েছেন সোনা-বরদার দলে যারা যারা আছে সকলকে মার্কুইস-এর হাতে সমর্পণ এবার জন্যে।
মার্কুইসরূপী সোরাবিয়া অত ব্যস্ত হয়ে তাই প্রথমে রাজপুরোহিত ভিলিয়াক ভমুর খোঁজ করেছে।
তাঁকে না পেয়ে শেষ পর্যন্ত জন দুই অধস্তন পুরোহিতকে সে পাকড়াও করবার ব্যবস্থা করলে।
তারা নেহাত তাঁবেদার। সত্যিই কিছুই জানে না। রাজপুরোহিত কয়েকদিন আগে খুব তাড়াহুড়ো করে সৌসা গেছেন এই খবরটুকুই তারা দিতে পারলে।
টম্বেজ বন্দরে পা দেওয়ার পর থেকে কামালকা হয়ে কুজকো পর্যন্ত আসার মধ্যে মার্কুইসরূপী সোরাবিয়া এ রাজ্যের হালচাল যতখানি সম্ভব জেনে নিয়েছে।
সৌসা যে একটা কারাদুর্গ, কামালকায় যে বন্দি তারই বড় বৈমাত্র ভাই ভূতপূর্ব ইংকা হুয়াসকার যে সেখানে বন্দি হয়ে আছে সে খবর তার অজানা নয়।
ভিলিয়াক ভূমুর শশব্যস্ত হয়ে সেখানে হঠাৎ যাওয়া বেশ একটু সন্দেহজনক মনে হল তার। রেইমির মতো এ রাজ্যের প্রধান উৎসবের প্রথম লগ্নেও সেখান থেকে না এসে পৌঁছোনো আরও।
এর ভেতরেও সেই শয়তান গানাদোর কোনও কারসাজি থাকা অসম্ভব নয় বলেই তার সন্দেহ হল।
গানাদোকে অবিলম্বে খুঁজে বার করা তাই একান্ত দরকার। তাঁবেদার পুরোহিতদের কাছে খবর নিয়ে যা সে জানল তা-ও বেশ একটু, গোলমেলে।
রাজপুরোহিত ভিলিয়াক ভমু নিজেই নাকি এবারের সোনা বরদার দলের সকলকে বন্দি করে গেছেন।
শুধু তাদের একজনকে নাকি পাওয়া যায়নি। কাকে পাওয়া যায়নি?
তাঁবেদার পুরোহিতরা তার নামধাম পরিচয় কিছু জানে না। শুধু রাজপুরোহিতের সঙ্গে দেখা করবার সময় যারা তাকে দেখেছিল ও পরে কোরিকাঞ্চার অতিথিশালায় তাকে বন্দি করতে গেছল রাজপুরোহিতের আদেশে, তারা খানিকটা বর্ণনা দিতে পারল তার চেহারার।
সোরাবিয়ার পক্ষে ওইটুকুই যথেষ্ট।
খোঁজ যার পাওয়া যায়নি সে যে গানাদো ছাড়া আর কেউ নয় এবিষয়ে সন্দেহ। আর তার রইল না।
রাজপুরোহিত ভিলিয়াক ভমুও, যে কোনও কারণেই হোক, গানাদোর শত্রু। হয়েছেন বুঝল সোরাবিয়া। এই কুজকো শহর থেকে রাজপুরোহিতের তীক্ষ্ণ সজাগ পাহারা এড়িয়ে তা হলে গানাদো গেল কোথায়!
আবার কাক্সামালকার দিকে সে যেতে পারে?
না, তা সম্ভব নয়। জোর গলায় জানালে চেলা পুরোহিতরা।
তা হলে সৌসার দিকে?
না, তা-ও নয়। কুজকো থেকে বার হবার প্রায় অগম্য যে পথ আছে তাতেও ভিলিয়াক ভূমুর আদেশে এমনভাবে কড়া পাহারা দেওয়া হচ্ছে যে একটা মাছিরও সাধ্য নেই তার ভেতর দিয়ে গলে যাবার।
তা হলে গানাদো এই কুজকোতেই আছে নিশ্চয়।
তা-ও অসম্ভব।ভয়ে ভয়ে নিবেদন করলে কোরিকাঞ্চার তাঁবেদাররা, এক এক করে এ শহরের প্রত্যেকটি মানুষের হিসেব নেওয়া হয়েছে, মায় বাইরে থেকে তীর্থযাত্রী হিসেবে যারা এসেছে তাদেরও।
সে লোকটা কি তা হলে হাওয়ায় মিলিয়ে যাবার মন্ত্র জানে!—তীক্ষ বিদ্রূপ করলে সোরাবিয়া।
তা-ই জানে বোধহয়। এবারও সসম্রমে জানালে ছোট পুরোহিতরা।
তা হলে হাওয়া শুষে নেবার মন্ত্র আমিও জানি। হিংস্রভাবে বললে সোরাবিয়া। একটা দরকারি কাজ আগে সেরে আসি, তারপর গানাদোকে খুঁজে পাওয়া যায় কি আমি দেখছি।
সঙ্গী হেরাদাকে সে শুধু রিসালার অর্ধেক সওয়ার দিয়ে পাঠাল সৌসায় গিয়ে রাজপুরোহিত ভিলিয়াক ভমুর খবর নিতে।
কী দরকারি কাজটা সোরাবিয়া আগে সারতে চায় সেটা বোঝা গেল খানিক বাদেই।
কোরিকাঞ্চার ছোট মোহান্তদের সঙ্গে আলাপ সেরে ফেলিপিলিওকে সঙ্গে রেখে বাছাই জন-পাঁচেক সওয়ার সেপাই নিয়ে সোরাবিয়া ব্যস্ত হয়ে ফিরে এল সূর্যবরণ প্রান্তরের মাঝখানে মৃত ইংকা হুয়াইনা কাপাক-এর শব-সভা যেখান সাজানো হয়েছিল সেইখানে।
কিন্তু কোথায় সেখানে ইংকাশ্রেষ্ঠ হুয়াইনা কাপাক-এর শব-সভা। রেইমির উৎসব গেছে পণ্ড হয়ে। বেলা বেড়ে সূর্য তখন পুবের আকাশে অনেক ওপরে উঠে এসেছে। হানাদার এসপানিওলদের ভয়ে সমস্ত সূর্যবরণ প্রান্তরই ফাঁকা। হুয়াইনা কাপাক-এর শব-সভার কোনও চিহ্ন সেখানে নেই।
কোথায় গেল সে-সব? চড়া গলায় জিজ্ঞাসা করেছে সোরাবিয়া।
কী-সব কোথায় গেল? বুঝেও না বোঝার ভান করেছে ফেলিপিলিও।
সেই সোনার সিংহাসন আর দামি দামি আসবাবপত্রগুলো, কার একটা মড়াকে যার মাঝে বসিয়ে রেখেছিল? এত করে বোঝাতে হবার জন্যেই মেজাজ গরম হয়ে গিয়েছে সোরাবিয়ার।
সেগুলো যেখানকার সেখানেই নিয়ে গেছে। ফিলিপিলিও ওইটুকুই জানিয়েছে উত্তরে।
সেই যেখানটা কোথায় জানতে চাইছি! খিঁচিয়ে উঠেছে সোরাবিয়া! ধমক দিয়ে বলেছে, নিয়ে চলো সেখানে।
ফেলিপিলিও মিছেই এসপানিওলদের সঙ্গ এতদিন করেনি। দেশের কুলাঙ্গার হলেও মানসম্রম সব একেবারে পায়ে লুটিয়ে দিয়ে বিদেশিদের গোলাম সে হয়নি। নিজের প্যাঁচালো ধারালো বুদ্ধিতে এই বিদেশিদের দম্ভ আর আস্ফালনের যোগ্য জবাব সে দিতে শিখেছে।
বাইরে অত্যন্ত বিনীত চেহারা ফুটিয়ে মোলায়েম গলায় সে তার অক্ষমতা জানিয়েছে। বলেছে যে, কোথায় সে সব সরানো হয়েছে তা তার জানা নেই।