সেই গানাদো তলোয়ারের খেলায় এসপানিয়ার কিংবদন্তির বীর এল সিড-এর মতো অদ্বিতীয়? সে-ই ভীরাকোচার অবতার সেজে এসপানিওল সৈনিকদের জব্দ করে মুখে কলঙ্ক-চিহ্ন দেগে দেয়? কেন?
পিজারোর কেন? প্রশ্নের ভালরকম জবাবই দিয়েছে সোরাবিয়া।
গানাদোর শয়তানির অকাট্য প্রমাণ হিসেবে জানিয়েছে যে গানাদো আসলে পলাতক এক ক্রীতদাস। মেক্সিকো থেকে স্পেনের যাত্রী এক জাহাজে হিড্যালগো সেজে যাবার সময় সোরাবিয়া তার ছদ্ম পরিচয় ধরে ফেলার পর থেকেই সে নিরুদ্দেশ। পানামাতে একবার ধরা পড়তে পড়তে সে পালিয়ে বেঁচেছে। এসপানিয়ার ফেরারি গোলাম বলেই সব এসপানিওল-এর ওপর তার রাগ। সুযোগ পেলেই সে তাই এসপানিওলদের বিরুদ্ধে প্রতিশোধ নেবার চেষ্টা করে। শয়তানের সাকরেদটা বেদে বলে নিজের পরিচয় দিলেও সত্যিই জাতবেদে নয়। সোরাবিয়া বেদেদের বড় ঘাঁটি ত্রিয়ানায় খোঁজ নিয়ে তা জেনেছে। কোথা থেকে তলোয়ারের খেলা সে অবশ্য আশ্চর্যরকম শিখেছে। খোদ শয়তানই তাকে শিখিয়েছে হয়তো। নইলে তলোয়ারের সূক্ষ্ম ফলার অমন আশ্চর্য কেরামতি মানুষের হাতে সম্ভব নয়। ইচ্ছে করলে সে বুঝি খেলতে খেলতে তলোয়ারের ডগায় শত্রুর মুখে নিজের নামও লিখে দিতে পারে। তার তলোয়ারের কাজ থেকেই সোরাবিয়া তাকে চিনেছে।
গানাদো যত বড় ওস্তাদই হোক, সাপের ওপরেও নেউল আছে। সোরাবিয়াকে বেকায়দায় একবার পেয়ে সে হাত ফসকে পালিয়েছিল। কিন্তু দুবারের বার আর নয়। তলোয়ারের ডগায় নাম লেখার কসরত সোরাবিয়া সাধবার চেষ্টা করেনি, কিন্তু এফোঁড় ওফোঁড় করার কেরামতিতে তার জুড়ি সে দেখতে চায়।
পিজারো ধৈর্য ধরে যে এত সব আস্ফালন শুনেছেন তার কারণ মনে মনে তখনও তিনি বেশ একটু বিভ্রান্ত। গানাদো সম্বন্ধে কী ধারণা তিনি করবেন তা তখনও ঠিক করে উঠতে পারছেন না।
মার্কুইস গঞ্জালেস দে সোলিসকে গণ্যমান্য হিড্যালগো বলেই তিনি অবশ্য ধরে নিয়েছেন। কিন্তু এরকম লোকের কথাও একেবারে নির্বিচারে বিশ্বাস করা যায় কি? মার্কুইস-এরও তো ভুল হতে পারে!
মার্কুইসকে এর আগে পিজারো কখনও দেখেননি। নামটাও কখনও শুনেছেন কি
প্রথমে ঠিক মনে করতে পারেননি। নাম না শোনা অবশ্য আশ্চর্য কিছু নয়। পিজারো তো আর কর্টেজ-এর মতো নিজেই খানদানি ঘরের ছেলে নয়। আদি পরিচয় তো তাঁর শুয়োরের রাখাল। জারজ সন্তান যাকে বলে, তা-ও। বড় ঘরোয়ানাদের কোনও খবরই তিনি রাখেন না।
মার্কুইস-এর চালচলন আর আত্মপরিচয় দেওয়া থেকেই পিজারো তাকে বিশ্বাস করেছেন। তা ছাড়া সেভিল-এ নেমে দেনার দায়ে বন্দি হবার পর সম্রাটের আদেশে মুক্ত হয়ে টোলেডোতে রাজদরবারে নিজের আর্জি পেশ করতে গিয়ে এইরকম একটা নাম যেন শুনেছিলেন বলে পরে মনে পড়েছে। টোলেডোর রাজদরবারে এইরকম নামের কেউ যেন তাঁর সেভিল-এ বন্দি থাকার কথা প্রথম জানিয়েছিল।
মার্কুইস গঞ্জালেস দে সোলিসই সেই লোক কি না, পিজারো অবশ্য জিজ্ঞেস করেননি। মার্কুইস হিসেবে সোরাবিয়া নিজের গরজেই তা চেপে গিয়েছে।
মার্কুইস হিসেবে সমীহ করলেও তার সব কথা নির্ভুল বলে পিজারো যেমন মনে করেননি তেমনই কতকগুলো ইঙ্গিত যে তার আশ্চর্যরকম মিলে গেছে তা-ও অস্বীকার করতে পারেননি নিজের মনে।
গানাদোই আতাহুয়ালপার কাছ থেকে সোনার পাহাড় আদায় করবার ফন্দি ভেবে বার করেছিল ঠিকই, কিন্তু তার পক্ষে সে সোনার এতটুকু বখরা দাবি না করা বেশ একটু অবিশ্বাস্য।
নিজের পরিচয় যা সে দিয়েছে তা সত্যি হলে সোনার লোভ এভাবে তার ত্যাগ করার কথা তো ভাবাই যায় না।
যদি কোনও কারণে সে মারা পড়ে থাকে ইতিমধ্যে তা হলে অবশ্য আলাদা কথা। কিন্তু তা-ও তো একদিক দিয়ে অসম্ভব বলেই মনে হয়। অসুখে বিসুখে দুর্ঘটনায় কিংবা নিজেদের মধ্যে মারামারি করে দু-একজন এসপানিওল সৈনিক মাঝে মাঝে মারা যায় না এমন নয়। কিন্তু তাদের মৃতদেহ তো গায়েব হয়ে যায় না এমন ভোজাবাজিতে? নিজেদের মধ্যে মারামারি করলে তা একেবারে গোপনও থাকে না। সিপাই মহলে। তা জানাজানি হয়ে যায়ই না কোনও-না-কোনও দলের মধ্যে। গানাদোর সঙ্গে কারোও সে রকম মারাত্মক কেন, ছোটখাটো ঝগড়ার কথাও কেউ জানে না!
নিজেদের মধ্যে মারামারিতে না হয়ে এদেশের কারও হাতে তার নিহত হওয়াও বিশ্বাসের অযোগ্য। এরকম ঘটনা এ পর্যন্ত ঘটেনি। রহস্যময় ভীরাকোচার অবতারের কাছে যাদের চরম লাঞ্ছনা হয়েছে তারাও কেউ প্রাণে মারা যায়নি। গেলেও তাদের লাশগুলো অদৃশ্য হত না নিশ্চয়!
সবচেয়ে আশ্চর্যের কথা এই যে গানাদোর কামালকা থেকে অন্তর্ধানের পর থেকে ভীরাকোচার অবতারের নামে যে উপদ্রব এসপানিওল সৈনিকদের ওপর হচ্ছিল তা একেবারে থেমে গেছে। সেরকম ঘটনা একটাও তার পর আর ঘটেনি।
মার্কুইস-এর সন্দেহ তাই একেবারে ভুল বলে উড়িয়ে দেবার নয়। কিন্তু গানাদো সত্যিই যদি অমন সাংঘাতিক মানুষ হয় তা হলে এখন তার সন্ধান কী করে পাওয়া যাবে? কামালকা শহরে সে নেই। এ শহর ছেড়ে কোথাও সে গেছে এমন কোনও প্রমাণও পাওয়া যাচ্ছে না।
মার্কুইসরূপী সোরাবিয়া এ রহস্যও ভেদ করেছে। নানারকম প্রশ্ন করে সে জেনেছে যে কামালকা থেকে একমাত্র সোনা বরদার দল ছাড়া বাইরে যাবার সুবিধে কেউ পায়নি। সোনা-বরদার দলের সবাই পেরুর লোক। কিন্তু তাদের সাজ-পোশাক দেখবার পর এই ছদ্মবেশেই যে গানাদো সকলের চোখে ধুলো দিয়ে পালিয়েছে এ বিষয়ে মার্কুইস-এর আর সন্দেহ থাকেনি।