মেদেলিন শহরে যমপুরীর মতো কারাগার থেকে পালিয়ে আসবার পর আর কোনওদিন সোরাবিয়ার সঙ্গে সাক্ষাৎ হবার সম্ভাবনা সত্যি ছিল না। সারাবিয়ার হাতেই ভাগ্যের চক্রান্তে কাপিন সানসেদোর সঙ্গে সেবার ধরা পড়েছিলেন বটে, তারই ঘুষ আর প্রতিপত্তির দরুন চালানও হয়েছিলেন অমন জীবন্ত কবরে, কিন্তু সেখান থেকে প্রায় অলৌকিকভাবে উদ্ধার পাবার পর সোরাবিয়ার জগৎ চিরকালের মতো ছেড়ে আসতে পেরেছেন বলেই ধারণা হয়েছিল গানাদোর।
সোরাবিয়া তো আর তখন যেমন-তেমন কেউ নয়, দস্তুরমতো মার্কুইস গঞ্জালেস দে সোলিস। গানাদো আর সানসেদোর কারাগার থেকে পালাবার খবর পেয়ে রাগে যত আগুনই সে হোক, গানাদোকে নিয়ে মাথা ঘামাবার সময় আর উৎসাহ তার না থাকবারই কথা। অভিজাতদের একজন হিসেবে এসপানিয়ার আমিরি ফেলে একটা হাঘরে ঘেয়ো কুকুরের মতো তাড়া-খেয়ে-ফেরা গোলামের পেছনে সে ছুটে মরবে কেন? আক্রোশ তার যা ছিল সে গোলামের বিরুদ্ধে তা তো মিটেই গেছে। যদি বা কিছু অবিশিষ্ট থাকে তা এমন তীব্র নিশ্চয় নয় যে এসপানিয়ার ঐশ্বর্য বিলাস প্রতিপত্তি সব বিসর্জন দিয়েই এই অজানা বিপদের রাজ্যে পাড়ি দেওয়াতে পারে।
এত জায়গা থাকতে এই সূর্য কাঁদলে সোনার দেশেই সোরাবিয়ার আসাটা তাই একটু বেশি অদ্ভুত লাগে গানাদোর। গানাদোর সন্ধানেই সোরাবিয়া সব কিছু ছেড়ে বেরিয়েছে এই অসম্ভব ব্যাপারও যদি সত্যি হয় তা হলেও ঠিক এই রাজ্যেই সে আসে কেমন করে? গানাদো যে এখানে এসেছেন তা তো তার কোনওমতেই জানবার কথা নয়।
২৬. গানাদো অনেক কিছুই ভাবেন
গানাদো অনেক কিছুই ভাবেন, কিন্তু এক হিসেবে যে নিয়তি সোরাবিয়ার সঙ্গে প্রথম সাক্ষাৎ থেকে তাঁর জীবনে অপ্রত্যাশিত বিপর্যয়ের অভিশাপ এনেছে, সেই নিয়তিই যে সোরাবিয়াকে নাটকের শেষ অঙ্কের জন্যে তার নিজের অগোচরে এই দুর্গম ইংকা সাম্রাজ্যে এনে ফেলেছে সেইটুকু ঠিক কল্পনা করতে পারেন না।
কেমন করে আর পারবেন? পিজারোর জাহাজে সেভিলের বন্দর ছাড়বার পর তাঁর ও কাপিন সানসেদোর পিছু নিয়ে সোরাবিয়া যে কতদূর পর্যন্ত ধাওয়া করেছে, তা গানাদো জানেন না। সেই অনুসরণের পথেই মার্কুইস গঞ্জালেস দে সোলিসরূপী সোরাবিয়ার হঠাৎ এসপানিয়া আর যে নিরাপদ মনে হয়নি, মান সম্রম ঐশ্বর্য প্রতিপত্তি সবকিছু জলাঞ্জলি দিয়েও নিজের দেশ থেকে কিছুদিনের জন্যে নিরুদ্দেশ হওয়া বুদ্ধিমানের কাজ বলে যে মনে হয়েছে, এ খবরও গানাদো পাননি।
কদোভার ঘাটে কর্টেজ-এর সঙ্গে অকস্মাৎ দেখা হবার পরই সোরাবিয়া শুধু কদোভা কি নিজের নতুন আস্তানার শহর মেদেলিন নয়, এসপানিয়াই ত্যাগ করবার ব্যবস্থা করেছে।
এসপানিয়া সে চিরকালের জন্যে ছাড়েনি। কিছুকাল বাইরে কোথাও কাটিয়ে। কর্টেজ-এর সন্দেহে তার সম্বন্ধে বেয়াড়া প্রশ্ন যদি কিছু ওঠে, সেটাকে থিতিয়ে দেবার সময় দিতে চেয়েছে।
আর সব জায়গা থাকতে তার পেরুতে আসাটা একেবারে আকস্মিক অবশ্য নয়। কর্টেজ-এর নিজের রাজ্য মেক্সিকোতে যাবার কথা ভাবাই যায় না। ফার্নানদিনা হিসপানিওলা এমনকী পানামায় পর্যন্ত বড় চেনাশোনার ভিড় বেড়ে গেছে। গা ঢাকা দিয়ে কিছুকাল থাকবার পক্ষে সেগুলো খুব প্রশস্ত নয়।
এসব রাজ্য ছেড়ে দিলে বাকি থাকে অজানা দুর্গম রহস্যময় এক সোনায় মোড়া কিংবদন্তির দেশ।
সোরাবিয়া বেপরোয়া হয়ে সেখানেই পাড়ি দিয়েছে। অজ্ঞাতবাসকে অজ্ঞাতবাস হবে, তারই সঙ্গে ভাগ্য একটু সদয় হলে সেখান থেকে সোনার কাঁড়িও নিয়ে আসা যেতে পারে।
ভাগ্য যে তার ওপর সদয় টম্বেজ বন্দরে জাহাজ থেকে নামবার পরই তার যেন প্রমাণ পেয়েছে। ভাগ্য অনুকূল না হলে ওখানেই গাল্লিয়েখোর সঙ্গে দেখা হবে কেন?
গাল্লিয়েখোর বিবরণ শুনতে শুনতেই উত্তেজিত হয়ে উঠেছে সোরাবিয়া। দুনিয়ায় আর সবাই ভুল করতে পারে, কিন্তু পেরুর আদি ভীরাকোচার নতুন অবতারের রহস্য যে কী, সে বিষয়ে তার ধারণা একেবারে অভ্রান্ত হতে বাধ্য।
ভাগ্য যেন এ নতুন রাজ্যে তার প্রতিষ্ঠা প্রতিপত্তির চাবিকাঠি নিজে থেকে তার হাতে তুলে দিয়েছে।
এসপানিওল সেনাপতি পিজারোর কাছে এ রহস্যভেদের বাহাদুরি দেখাতে পারলে একমুহূর্তে তার কদর বেড়ে যাবে।
সে বাহাদুরি দেখাতে যে সে পারবে, এ বিষয়ে কোনও সন্দেহ সোরাবিয়ার নিজের মনে তখন নেই। তলোয়ার চালাবার কৌশলের একটি নমুনার কথা শুনেই সে চিনে ফেলেছে ভীরাকোচার অবতারকে! এ দেশের মর্কটগুলোর তো নয়ই, একটি মাত্র লোকের ছাড়া এসপানিওল বাহিনীরও কারও তলোয়ারের কাজের অমন সূক্ষ্ম কেরামতি নেই, যাতে যেখানে খুশি ওই চিকে-র দাগ দেওয়া যায়।
কথায় কথায় গানাদো নামে এক ত্রিয়ানার বেদে এসপানিওল বাহিনীতে আছে জেনে আর উত্তেজনা চেপে রাখতে পারেনি সোরাবিয়া। সেইদিনই গাল্লিয়েখোকে নিয়ে রওনা হয়েছে কাক্সামালকার উদ্দেশে।
কামালকায় যখন সে গিয়ে পৌঁছেছে, গানাদো তখন সেখান থেকে নিরুদ্দেশ। পিজারো তার নিরুদ্দেশ হওয়ার ব্যাপারে চিন্তিত হয়েছেন, কিন্তু খুব বেশি গুরুত্ব ব্যাপারটায় দেওয়া প্রয়োজন মনে করেননি।
মার্কুইস গঞ্জালেস দে সোলিসরূপী সোরাবিয়া কামালকায় এসে তাঁর সঙ্গে দেখা করে যা বলেছে, তা পিজারো বিশ্বাসই করতে পারেননি প্রথমে।
গানাদো, মানে ওই সামান্য বেদেটা এমন আশ্চর্য কেউ? তার বুদ্ধি আর কাণ্ডজ্ঞানের পরিচয় অবশ্য আগে অনেকবার পেয়ে মনে মনে তারিফ করতে বাধ্য হয়েছেন। সত্যি কথা বলতে গেলে আতাহুয়ালপার কাছ থেকে সোনার কাঁড়ি আদায় করবার ফন্দি নিজের মাথা থেকে সে-ই বার করেছিল। লোকটাকে কেন তাঁর বরাবর যেন চেনা-চেনা লেগেছে, তা ঠিক মনে করতে না পারলেও, তার কয়েকটা পরামর্শের জন্যে তার প্রতি একটু কৃতজ্ঞই বোধ করছেন।