কিন্তু যাকে খুঁজছেন, মৃদু প্রতিবাদের ছলে একটু রহস্য করে ফেলিপিলিও, সে-ই এখনও বেঁচে আছে তারই বা ঠিক কী!
মরে গিয়ে থাকলে, পৈশাচিক আক্রোশের সঙ্গে বলে মার্কুইস দে সোলিস, কবর খুঁড়েও তার লাশ আমি টেনে বার করব। জ্যান্ত বা মড়া যাই হোক, আমার হাত থেকে তার নিস্তার নেই। চলো এখন, রাজপুরোহিতের জায়গায় কাকে পাওয়া যায় দেখি।
কোরিকাঞ্চার অন্য ছোটখাটো পুরোহিতের খোঁজে ঘোড়া চালিয়ে এবার এগিয়ে যেতে যেতে মার্কুইস দে সোলিস হঠাৎ পিছু ফিরে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করে, সোনার সিংহাসনে বসানো ও বাসি পচা মড়াটা কার বললে যেন, কোন বাঁদির বাচ্চার?
বাঁদির বাচ্চার নয়,-এসপানিওলদের কাছে নিজেকে বিকিয়ে-দেওয়া দেশের দুশমন বিভীষণ হলেও ফেলিপিলিওর গলার স্বর একটু তেতোই শোনায়-কুজকো থেকে কুইটো পর্যন্ত সমস্ত রাজ্যের যিনি অধীশ্বর ছিলেন ও পবিত্র শবদেহ ইংকাশ্রেষ্ঠ সেই হুয়াইনা কাপাক-এর।
হুঁ, গলায় যেন ভক্তি ভক্তি ভাব পাচ্ছি! বিদ্রূপ করে মার্কুইস, তোমাদের রাজা-গজা যা-ই হোক, আমার কাছে সব বাঁদির বাচ্চা। এখান থেকে ফেরবার সময় ও লাশটা তলোয়ারের খোঁচায় টেনে ফেলে দিয়ে সিংহাসনটা সঙ্গে নিয়ে যাব। ওটা নিরেট সোনা মনে হচ্ছে।
নিরেট সোনার সিংহাসনে হুয়াইনা কাপাক-এর শব সেজে নিস্পন্দ গানাদোর কানে প্রত্যেকটা কথা যেন গলানো সিসের মতো গিয়ে পড়ে।
অপ্রত্যাশিত বিশ্রীগোছের কিছু একটা যে হয়ে গেছে এবিষয়ে আর সন্দেহ থাকে গানাদোর।
মার্কুইসরূপী সোরাবিয়া সঙ্গী হিসেবে হেরাদাকে নিয়ে তাঁরই খোঁজে যে এসেছে তা স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে।
শুধু নিজেদের মর্জিতে হেরাদা বা সোরাবিয়ার পক্ষে সওয়ারবাহিনী নিয়ে কামালকা থেকে কুজকোয় আসা সম্ভব নয়। সেনাপতি পিজারোর অনুমতি তো বটেই, সমর্থন জানানো আদেশও এই দুই মানিকজোড় পাষণ্ড পেয়েছে নিশ্চয়।
তাঁকেই বিশেষ করে খুঁজতে আসার কারণ কী? সোনাবরদার হয়ে তাঁর কামালকা থেকে পালানো কি ধরা পড়েছে?
শুধু সেটুকু ধরা পড়লেও এমন কিছু সর্বনাশ হবে না। সেখানে যে চাকা ঘোরাবার নানাদো তার যথোচিত ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। এখন তাঁর পেছনে ধাওয়া করে, এমনকী তাঁকে গ্রেপ্তার করলেও পেরুর বিদ্রোহের দাবানল নেভানো যাবে না।
সৌসা থেকে হুয়াসকার আর কামালকা থেকে আতাহুয়ালপা একবার রওনা হতে পারলে আর ভাবনা নেই।
কিন্তু আতাহুয়ালপার সঙ্গে তাঁর চক্রান্ত যদি ফাঁস হয়ে গিয়ে থাকে, তা হলে তো সবকিছুই ব্যর্থ।
না, তা কখনওই হয়নি—মনে মনে বিচার করে ধারণা হয় গানাদোর। আতাহুয়ালপাকে যেটুকু চিনেছেন, তাতে তিনি কুটিল ক্রুর স্বার্থপর দাম্ভিক সবকিছু হতে পারেন কিন্তু সম্রাটোচিত মর্যাদাবোধে তিনি পৃথিবীর কোনও নৃপতির চেয়ে কম যান না। যারা তাঁকে বন্দি করে রেখেছে, তাদের চেয়ে তিনি অনেক ওপরের স্তরের মানুষ। ইংকা রক্তের স্বাভাবিক আভিজাত্যে তিনি এ পার্বত্য রাজ্যের তুষারমৌলি উত্তুঙ্গ শিখরের মতোই স্বতন্ত্র ও অসাধারণ। আতাহুয়ালপা সুতরাং কোনও কারণেই নিজের দেওয়া প্রতিশ্রুতি ভাঙবেন না। রাজত্ব ফিরে পাওয়ার প্রলোভনে কিংবা চরম উৎপীড়নে আর মৃত্যুভয়েও কোনও গোপন কথা বার হবে না তাঁর মুখ থেকে। আর আতাহুয়ালপা ছাড়া এ বিদ্রোহের গোপন আয়োজনের কথা বিন্দুবিসর্গও যে জানে এমন কাউকে গানাদো কামালকায় রেখে আসেননি। এ ষড়যন্ত্রের আর একজন মাত্র অংশীদার পাউল্লাে টোপা তাঁর সঙ্গেই কুজকোতে এসেছে। এখানে রাজপুরোহিত ভিলিয়াক ভমুর হাতে ধরা পড়ে সে হয়তো উৎপীড়নে কিছু কিছু গোপন কথা প্রকাশ করে ফেলেছে। পাউলো টোপার পক্ষে যা প্রকাশ করা সম্ভব, তা রাজপুরোহিতের কাছে নতুন কিছু নয়। তিনি ইতিমধ্যে গানাদোর কাছেই তার বেশি কিছু জেনেছেন। যা জেনেছেন, সে খবর কিন্তু কামালকায় পৌঁছে দেবার
জন্যে রাজপুরোহিত একটুও ব্যস্ত হবেন কি না সন্দেহ। এ ধরনের গুপ্ত ষড়যন্ত্র ধরে দেওয়ার ঝুঁকি তো কম নয়। তার উপযুক্ত প্রমাণ না দিতে পারলে হিতে বিপরীত হতে পারে। তা ছাড়া এখান থেকে খবর পাঠালেও ইতিমধ্যে কামালকা থেকে তার জবাবে এসপানিওল রিসালার কুজকোয় এসে হানা দেওয়া সম্ভব নয়।
সুতরাং আতাহুয়ালপার কাছ থেকে গোপন ষড়যন্ত্র ফাঁস হয়নি যেমন ধরে নেওয়া যেতে পারে, রাজপুরোহিতের কাছ থেকেও কোনও খবর কাক্সামালকায় যায়নি এ কথা বিশ্বাস করতে পারা যায় তেমনই।
ষড়যন্ত্র প্রকাশ না পাওয়ার আর একটা প্রমাণ এই বলে গানাদোর মনে হয় যে, এরকম একটা সর্বনাশা কিছুর আঁচ পেলে পিজারো শুধু সোরাবিয়া আর হেরাদার নেতৃত্বে ছোট একটা রিসালা কুজকো পর্যন্ত পাঠিয়ে নিশ্চিন্ত হতেন না।
সোরাবিয়ার আর হেরাদার আলাপে শুধু তাঁর কথাটাই প্রধান হয়ে উঠত না অতখানি।
গানাদোই তা হলে কামালকা থেকে এসপানিওল রিসালার কুজকো অভিযানের একমাত্র লক্ষ্য বলে বোঝা যাচ্ছে। এসপানিওলদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র যদি প্রকাশ না হয়ে থাকে—হয়নি বলেই নিশ্চিত ধরে নেওয়া যেতে পারে—তা হলে তাঁর এতবড় সম্মান পাওয়ার কারণ কী?
শুধু পলাতক একজন এসপানিওল সৈনিকের জন্যে এত মাথাব্যথা পিজারোর হতে পারে না যে তাকে ধরতে ছোটখাটো একটা সওয়ার দল পাঠাবেন।
সে সওয়ার দলের নায়ক আবার সোরাবিয়া!
সোরাবিয়া কোথা থেকে এসে কী করে এ বাহিনীর নায়ক হয় সেইটেই ঠিক বুঝে উঠতে পারেন না গানাদো।