সেই পরম মুহূর্তের জন্যেই তৈরি হয়েছিলেন গানাদো।
কিন্তু তার বদলে কোথা দিয়ে এ কী হয়ে গেল!
তাঁর চারিপাশ থেকে জনতা যেভাবে ব্যাকুল হয়ে ছুটে পালাচ্ছে, তাতে এসপানিওল সওয়ারেরা এদিকেই আসছে বুঝতে পারেন গানাদো। ঘোড়ার পায়ের শব্দ আর দ্রুত নয়, রিসালা এখন ধীরে সুস্থে অগ্রসর হচ্ছে।
মৃত ইংকা নরেশের সুসজ্জিত অলঙ্কার-ভূষিত শবদেহ হয়ে গানাদো সোনার সিংহাসনে নিস্পন্দ জড়ের মতোই হেলান দিয়ে আছেন। মুখে তাঁর মৃত্যু-মুখোশ আঁটা। মাথায় উষ্ণীষস্বরূপ নানারঙের প্লান্টু একটু সরে এসেছে কপালের ওপর, আর কপালের রাজশক্তির প্রতীক ঝালর-দেওয়া রক্তিম বোলা নেমে এসে চোখ দুটোকে চাপা দিয়েছে অনেকখানি।
প্লান্টু ও বোলা-র এ স্থানচ্যুতি একেবারে দৈবাৎ নয়, অলক্ষ্যে তাতে গানাদো সাহায্য লাভ করেছেন, চোখের জন্যে কাটা মৃত্যু-মুখোশের ফোকর দিয়ে অস্পষ্টভাবেও একটু দেখবার সুযোগের জন্যে।
বোর্লার রক্তরাঙা ঝালরের ভেতর দিয়ে গানাদো এসপানিওল সওয়ারদের নেতৃস্থানীয় দু-জনকে তাঁর চারিধারের বেষ্টনীর কাছে ঘোড়া থামাতে দেখেন।
একজন তার মধ্যে তাঁর পরিচিত। মাকিয়াভেল্লী থেকে চুরি করা বিদ্যে জাহির করে যে কাক্সামালকার প্রথম মন্ত্রণাসভায় পিজারোকে শয়তানি পরামর্শ দিয়েছিল, সেই জুয়ান দে হেরাদা।
কিন্তু হেরাদার পাশে ওই সওয়ারটি কে?
ঘোড়ার পিঠে বসে পিছু ফিরে পেছনে কী যেন দেখছে বলে তার মুখটা গানাদোর বেয়াড়াভাবে হেলানো ও অনড় মাথার দৃষ্টি সীমার মধ্যে পড়ছে না, কিন্তু ঘোড়ার ও মালিকের সাজের বহর দেখে বোঝা যাচ্ছে লোকটা হেঁজি পেজি নয়।
হেরাদার হাঁক এবার শোনা যায় এই, কে তোরা? কোথায় তোদের রাজপুরোহিত ভিলিয়াক ভমু?
জবাব মেলে না কোনও গানাদোকে হুয়াইনা কাপাক-এর শবদেহ হিসেবে যারা পাহারা দিচ্ছে তারা ছাড়া জবাব দেবারও কেউ নেই। প্রহরীরা ভিলিয়াক ভমু নামটা ঠিকমতো শুনলে হয়তো কিছু বলার চেষ্টা করতে পারত, কিন্তু হেরাদার বিকৃত উচ্চারণে সে নাম তাদের বোধগম্য হয় না।
জবাব না পেয়ে গরম হয়ে ওঠে হেরাদা। দাঁত খিঁচিয়ে চিৎকার করে ওঠে, বোবা। সেজেছে সব? জিভগুলো কেটে সত্যিই বোবা বানিয়ে দিচ্ছি!
হেরাদা কোমরবন্ধ থেকে তলোয়ারটা প্রায় খুলতেই যাচ্ছে এমন সময় পেছন থেকে যে এসে তাকে বাধা দেয় সে-ও গানাদোর চেনা। দোভাষী ফেলিপিলিও।
মানুষ হিসেবে ফেলিপিলিও হেরাদারই যোগ্য সহচর। তবে আপাতত সে উচিত। প্রশ্নই করে।
একটু হেসে বলে, কাদের জিভ কাটতে যাচ্ছেন? এদের?
হ্যাঁ, যা জিজ্ঞেস করছি তার জবাব নেই। হেরাদা কুদ্ধ স্বরে বলে, আর স্পর্ধা দেখেছ হতভাগাগুলোর। আর সবাই তবু ভয়ে পালাচ্ছে আর এরা ঠায় দাঁড়িয়ে আছে গ্যাঁট হয়ে। হাতে আবার ঊচোনো বল্লম।
দোভাষী ফেলিপিলিও এবার ব্যাপারটা ব্যাখ্যা করে বোঝায়। লোকগুলো স্পর্ধা দেখাতে নয়, ভূতপূর্ব ইংকা নরেশ হুয়াইনা কাপাক-এর পবিত্র শবদেহ পাহারা দিতে ওখানে এদেশের চিরকালের সংস্কার মেনে অটল হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ফেলিপিলিওর এই বিবরণের মধ্যেই দ্বিতীয় সওয়ার নায়ক পেছন থেকে সামনে মুখ ফেরায়।
সচকিত বিস্ময়ে স্তব্ধ হয়ে যান গানাদো। অসামান্য সংযম না থাকলে সেই মুহূর্তে ভেতরের চাঞ্চল্য চাপতে না পেরে হয়তো ধরাই পড়ে যেতেন।
আর যাকে-ই হোক, ঠিক সেই মুহূর্তে কুজকো শহরের সেই সূর্য-বরণ প্রান্তরে এই মানুষটিকে এসপানিওল সওয়ারদের অন্যতম নায়ক হিসেবে দেখবার কথা গানাদো কল্পনাও করেননি।
মানুষটি আর কেউ নয়, মার্কুইস গজালেস দে সোলিস, কোনওকালে সোরাবিয়া নামে যে নেহাত নীচ ইতর জুয়াড়ি বলে পরিচিত ছিল, আর গানাদোর জীবনে একাধিকবার যে অশুভ গ্রহের মতো চরম দুর্ভাগ্যের দূত হয়ে অপ্রত্যাশিতভাবে দেখা দিয়েছে।
মার্কুইস গঞ্জালেস দে সোলিস ফেলিপিলিওকে তার ব্যাখ্যা শেষ করতে দেয় না। অধৈর্যভরে তাতে বাধা দিয়ে বলে, এ দেশের মর্কটগুলোর শাস্ত্রকথা শুনতে এখানে আসিনি। রাজপুরোহিত ভিলিয়াক মুর খবর পেয়েছ কিছু? আছে সে এখানে?
না, এখানে নেই। জানায় ফেলিপিলিও, মনে হচ্ছে কুজকো শহরেই নেই।
কী করে জানলে? সন্দিগ্ধ চড়া গলায় প্রশ্ন করে মার্কুইস দে সোলিস, মন্তর পড়ে নাকি? তুমি তো আমাদের সঙ্গেই এলে!
হ্যাঁ, আপনাদের সঙ্গেই এসেছি, বলে ফিলিপিলিও, কিন্তু রাজপুরোহিতকে আপনাদের চেয়ে একটু বেশি চিনি! কুজকো শহরে থাকলে তিনি ঘোড়ার খুরের শব্দ পেলে সবার আগে ছুটে এসে এখানে হাজিরা দিতেন।
বটে! ব্যঙ্গের সুরে বলে হেরাদা, হুঁশিয়ার মানুষ বোঝা যাচ্ছে। কিন্তু আজ এদের কী এক মস্ত জংলি পরব। এই পরবের দিনেও রাজপুরোহিতের এখানে না থাকাটা কী রকম?
হ্যাঁ, ব্যাপারটা একটু অদ্ভুত। স্বীকার করে ফেলিপিলিও, তারপর জানায় যে কোরিকাঞ্চার ছোটখাটো পুরোহিতদের কাউকে ধরে এখন খবর না নিলে নয়।
কিন্তু যাকে আমরা চাই, সেই গোলামটার খোঁজ দিতে পারবে ওরা? হিংস্রভাবে প্রশ্ন করে মার্কুইস গঞ্জালেস দে সোলিস।
না পারলে ওরা শুধু নয়, কুজকো শহরের কেউ রেহাই পাবে! হেরাদা যেন মনে মনে ভাবী উৎপীড়নটা কল্পনাতেই উপভোগ করে বলে, এ শহরের একটা মানুষকে তা হলে আস্ত রাখব না। খোঁজ না দিতে পারার শাস্তি একটি করে অঙ্গ। জ্যান্ত মানুষ কেউ পার পাবে না!