পারলে গানাদো একবার উঠে দাঁড়াতেন। জনতার মধ্যে একজন হয়ে এগিয়ে দেখতেন এসপানিওল রিসালায় কারা এসেছে আর কে তাদের নায়ক।
কিন্তু তার উপায় নেই। জনসমুদ্রে অস্থির দোলা লেগেছে সত্যিই, কিন্তু তাঁর চারিধারে একটা নিস্তরঙ্গ বেষ্টনী। তাঁকে ঘিরে যারা পাহারা দিচ্ছে, প্রাণ দিয়েও সে বেষ্টনী তারা রক্ষা করবার চেষ্টা করবে।
তবু নিস্পন্দ নিথর হয়ে বসে থাকা অসহ্য মনে হয় গানাদোর। একবার ইচ্ছা হয় হঠাৎ সাড়া দিয়ে উঠে বিহ্বলব্যাকুল এই জনসমুদ্র আর এক বিদ্যুৎ-বিস্ময়ে উত্তাল করে তুলবেন।
কিন্তু তার লগ্ন পার হয়ে গেছে। এখন তা শুধু নিরর্থক আত্মঘাতী মূঢ়তা। নির্মম দুর্ধর্ষ এসপানিওল বাহিনীর সামনে আকুল দিশাহারা গ্লামার পালের মতো পলাতক এই নিরস্ত্র নিরুপায় ভয়ার্ত জনতাকে কোনও অলৌকিক আবির্ভাব দিয়েও এখনই আর সংহত করা যাবে না।
চারিদিকের তীব্র উত্তেজনা ও বিশৃঙ্খলার আলোড়নের মধ্যে মহার্ঘ পোশাকে শবদেহের মতোই নিস্পন্দ হয়ে থাকেন গানাদো। তাঁকে ঘিরে উদ্যত বল্লম নিয়ে পাহারা দেয় তাঁর মর্যাদা রক্ষায় জীবনপণ করা প্রহরীরা।
তারা অবশ্য জানে যে, মহামহিম সূর্যসম্ভব ভূতপূর্ব ইংকা নরেশ হুয়াইনা কাপাক-এর মরদেহই তারা পাহারা দিচ্ছে।
হ্যাঁ, এই অবিশ্বাস্য গোপন আশ্রয়ই খুঁজে নিয়েছিলেন গানাদো রাজপুরোহিত ভিলিয়াক ভূমুর গভীর অভিসন্ধি অনুমান করে কয়াকে যেদিন পরম অভিজ্ঞান দিয়ে সৌসায় পাঠান, সেইদিনই।
কয়ার কাছে বিদায় নেবার পর কাক্সামালকা থেকে সোনাবরদার হয়ে যারা এসেছিল তাদের জন্যে বরাদ্দ অতিথিশালায় গানাদো ফিরে যাননি। বার হবারও চেষ্টা করেননি কুজকো নগর থেকে। সে চেষ্টা করলে রাজপুরোহিতের প্রহরীদের প্রখর দৃষ্টি এড়ানো তাঁর পক্ষে সম্ভব হত না। প্রহরীরা রাজপুরোহিতের কঠোর নির্দেশে প্রাণের দায়ে কুজকো শহরেও তাঁকে তন্নতন্ন করে খোঁজার ত্রুটি করেনি। তবু তাদের শিকার যে কুজকো থেকে জাদুবলে অদৃশ্য হয়েছে বলে তাদের মনে হয়েছে, তার কারণ গানাদো প্রথম দিন থেকেই ভূতপূর্ব ইংকা নরেশ হুয়াইনা কাপাক-এর জন্যে বরাদ্দ প্রাসাদেই আত্মগোপন করেছেন। পেরুবাসীর রীতিনীতি সংস্কার জেনে এফন্দি তিনি ভেবে রেখেছিলেন গোড়া থেকেই। বিশেষ একটি-দুটি উৎসব ছাড়া মৃত ইংকাদের প্রেত-প্রাসাদে কড়াকড়ি কোনও পাহারা থাকে না। থাকার প্রয়োজনও নেই। প্রেত-প্রাসাদে সাধ করে কেউ ঢুকতে বা সেখান থেকে যত মূল্যবানই হোক কোনও ঐশ্বর্য চুরি করতে চাইবে তাভান্তিন্সুইয়ুতে এ ব্যাপার কল্পনাতীত। জীবিত ইংকার চেয়ে মৃতের মর্যাদা পেরুবাসীদের কাছে বেশি বই কম নয়। এ প্রেত-প্রাসাদে যেসব প্রহরী আর অনুচর থাকে, তাদের আসল কাজ মৃত ইংকাদের প্রতাপ-প্রতিপত্তি মৃত্যুতেও যে অক্ষুণ্ণ অম্লান তারই প্রমাণস্বরূপ সাজসজ্জার ঘটা দেখানো। দরকার হলে নিজেদের পরম প্রভুর মর্যাদা রক্ষার জন্যে তারা সত্যিই প্রাণ দিতে প্রস্তুত, কিন্তু সেরকম কোনও প্রয়োজন কখনও হয় না বললেই চলে।
প্রেত-প্রাসাদের রক্ষণাবেক্ষণ নেহাত আনুষ্ঠানিক বলেই গানাদোর সেখানে লুকিয়ে থাকবার কোনও অসুবিধে হয়নি। প্রহরী ও অনুচরেরা কল্পনাই করতে পারেনি যে, মৃত ইংকা নরেশের শবদেহের কাল্পনিক সুখ-সাচ্ছন্দ্যবিধানের অনুষ্ঠান পালন করতে গিয়ে তারা সত্যিই জীবিত কারও পরিচর্যা করছে। হুয়াইনা কাপাক-এর আত্মার পরিতৃপ্তির জন্যে নৈবেদ্য হিসেবে তারা অপর্যাপ্ত খাদ্য পানীয় প্রতিদিন যথাবিধি তাঁর শবদেহের সামনে ধরে দিয়েছে। পরের দিন সে আহার্য সরিয়ে নিয়ে যাবার সময় তা থেকে যৎসামান্য খোয়া গিয়েছে কি না লক্ষই করেনি। রাত্রে ভিকুনার পশমে বোনা সুকোমল রাজশয্যা পেতে ইংকা নরেশের শয়নমন্দিরের দ্বার যখন তারা বন্ধ করে প্রেত-প্রাসাদের বাইরে নেহাত নিয়মরক্ষার পাহারা দিতে চলে গেছে তখন কেউ যে সে শয্যা সত্যিই ব্যবহার করতে পারে, তা তাদের স্বপ্নেরও অগোচর।
এই প্রেত-প্রাসাদেই রাজপুরোহিতের প্রহরীদের দৃষ্টি এড়িয়ে গানাদো দিন গুনেছেন রেইমি উৎসবের জন্যে। প্রহরীদের নিজেদের মধ্যেকার আলাপ আড়াল থেকে যতটা তিনি শুনেছেন, তাতে লক্ষণ সব শুভ বলেই মনে হয়েছে। কয়া সৌসা যাবার পথে ধরা পড়লে কুজকো নগরে একটা সাড়া পড়ে যেত নিশ্চয়ই। প্রেত-প্রাসাদের প্রহরীদের আলাপে তার আভাস পাওয়া যেত। সেরকম কিছু যখন পাওয়া যায়নি তখন কয়া সৌসায় পৌঁছে হুয়াসকার-এর সাক্ষাৎ নিশ্চয় পেয়েছে বুঝেছিলেন গানাদো। হুয়াসকার-এর একবার সাক্ষাৎ পেলে আর ভাবনার কিছু নেই! উত্তরায়ণের প্রথম লগ্নে না হোক, রেইমির উৎসবের মধ্যে তাঁর বাহিনী নিয়ে হুয়াসকার এসে পড়বেনই কুজকো শহরে। আতাহুয়ালপাও তখন কামালকা থেকে কুজকোর দিকে অর্ধেক পথ পেরিয়ে আসবেন। যে মহান লক্ষ্য নিয়ে তাঁরা মিলিত হচ্ছেন তারই সমর্থনে সমস্ত পেরুর দূরদূরান্ত থেকে তীর্থযাত্রীরা যেখানে সমবেত হয়েছে, সূর্যবরণের সেই পবিত্র বিশাল পার্বত্য-প্রান্তরে অলৌকিক এক দৈববাণী শোনা যাবে। শোনা যাবে যেন পূর্বতন ইংকানরেশ হুয়াইনা কাপাক-এর শবদেহের সংরক্ষিত মূর্তির মুখে। গানাদো জানতেন উত্তেজিত ধর্মপ্রাণ জনতা সন্দেহ করবে না সে দৈববাণীর যাথার্থ্য, প্রশ্ন করবে না তা নিয়ে। গভীর অন্ধবিশ্বাসে, দেশ ও জাতির পরম কলঙ্ক মোচনের আকুলতায়, নির্বিচারে মেনে নেবে সে বাণী। তারপর দেশপ্রেমের আবেগের সঙ্গে ধর্মবিশ্বাসের আন্তরকিতা মিলে যে প্রচণ্ড আলোড়নের সৃষ্টি হবে তার সামনে কোথায় দাঁড়াবে মুষ্টিমেয় ক-টা বিদেশি শত্রু!