সেই অন্ধ বিশ্বাসেই কি তাদের কেউ কেউ সোনার সিংহাসনে বসানো হুয়াইনা। কাপাক-এর সুসজ্জিত শবদেহে ঈষৎ প্রাণের স্পন্দন লক্ষ করে বিদ্যুৎ-শিহরন অনুভব করে সারা দেহে।
এই নিদারুণ সংকটে সত্যিই কি মহাশক্তিধর হুয়াইনা কাপাক আবার জেগে উঠবেন? অসামান্য বাহুবলে কুজকো থেকে কুইটো পর্যন্ত যিনি ইংকা সাম্রাজ্য বিস্তৃত করেছিলেন তিনিই কি আবার এসেছেন তাতিসুইয়ুকে বিদেশি গ্রাস থেকে মুক্ত করতে?
শঙ্কিত উৎকণ্ঠিত জনতার মধ্যে একটা উত্তেজিত গুঞ্জন শুরু হয়ে যায়।
পুবের আকাশ আরও পরিষ্কার হয়ে আসছে। কোরিকাঞ্চার উদ্বিগ্ন অধস্তন পুরোহিতেরা দিশাহারা হয়ে পড়েছেন, এ বিপদে কী যে করণীয় তা স্থির করতে না পেরে।
তাঁরা নিজেরাই কি কেউ আজ ইংকা নরেশ আর রাজপুরোহিতের হয়ে উত্তরায়ণের সদ্যোজাত সূর্যদেবকে বরণ করবার ভার নেবেন?
কিন্তু তাঁদের ধর্মের সবচেয়ে পবিত্র অনুষ্ঠানের এ নিদারুণ ত্রুটি রেইমি উৎসবের জন্যে সমবেত বিরাট জনতা মেনে নেবে বলে তো মনে হয় না। রাজপুরোহিত স্বয়ং এসে এখনও সব দিক রক্ষা করতে পারেন। আর কিছুক্ষণ দেরি হলে উত্তেজিত উৎকণ্ঠিত ধর্মপ্রাণ জনতার মধ্যে কী উত্তাল আলোড়ন যে জাগবে তা অনুমান করাই কঠিন।
এই অস্থির বিহ্বলতার মধ্যে জনতার গুঞ্জন পুরোহিতদের কানেও এসে পৌঁছোয়। ব্যাকুল হয়ে তাঁদের কেউ কেউ হুয়াইনা কাপাক-এর শবদেহের দিকে ছুটে যান।
পেরুর চরম দুর্দিনে এই ভয়ংকর সংকট মুহূর্তে সত্যিই কি এক অলৌকিক বিস্ময় প্রত্যক্ষ করবার সৌভাগ্য তাঁদের হবে? উত্তরায়ণের সূর্যকে বরণ করবার জন্যে অদ্বিতীয় ইংকা কুলতিলক হুয়াইনা কাপাক তাঁর সযত্নে সংরক্ষিত শবদেহ আবার সঞ্জীবিত করে তুলবেন? এ অঘটন কি সত্যিই সম্ভব?
সাধারণ জনতার সঙ্গে নিষ্পলক দৃষ্টিতে তাঁরাও স্বর্ণ-সিংহাসনে আসীন মূর্তির দিকে চেয়ে থাকেন। এ মূর্তির মধ্যে প্রাণের স্পন্দন প্রথম কে দেখেছে, কেউ জানে না। কিন্তু মুখে মুখে কথাটা বহুদূর পর্যন্ত ছড়িয়ে গেছে। পূর্ব দিগন্তে উৎসুকভাবে যারা চেয়েছিল তাদের অনেকেই ভূতপূর্ব ইংকা নরেশের শবদেহ যে রঞ্জু-বেষ্টনীর মধ্যে সাড়ম্বর স্বর্ণ-সিংহাসনে স্থাপিত তার চারিধারে ভিড় করে এসে জড়ো হয়।
সকলেই উত্তেজিত উৎকণ্ঠিত উৎসুক। অন্ধ বিশ্বাসের চোখে কি না বলা কঠিন, অনেকেই এবার শবদেহে একটা চাঞ্চলের আভাস পায়। যা তাদের স্বপ্নাতীত তাই কি এবার সত্যি ঘটতে চলেছে?
না ঘটবার কোনও হেতু নেই। কারণ এমনই একটি সুযোগের মুহূর্তের জন্যই নিখুঁতভাবে সমস্ত আয়োজন করা হয়েছে।
সৌসার কারাদুর্গ থেকে নিশ্চয় এতক্ষণে মুক্তি পেয়েছেন হুয়াসকার। মুক্তি পাবার সঙ্গে সঙ্গে তাঁর বিশ্বস্ত অনুরক্ত অনুচরবাহিনী নিয়ে এই কুজকোর অভিমুখেই তিনি এগিয়ে আসছেন ঝড়ের গতিতে। রেইমি উৎসবের আগে ব্রাহ্মমুহূর্তেই তাঁর সদলবলে কুজকোর এই সূর্যাবরণের প্রান্তরে এসে পৌঁছোবার কথা। তিনি এসে পৌঁছোবার সঙ্গে সঙ্গে যে উত্তেজনার সঞ্চার হবে তারই মধ্যে জেগে উঠবে অদ্বিতীয় ইংকা নরেশ হুইয়ানা কাপাক-এর শবদেহ। তাঁরই কষ্ঠে রেইমি উৎসবের জন্য সমবেত সমস্ত তাভানতিসুইয়ুর ভক্ত তীর্থযাত্রীরা শুনবে নবজাগরণের এক বহ্নিময়
বাণী।
যে কোনও কারণেই তোক হুয়াসকার রেইমি উৎসবের আগে কুজকোয় এসে পৌঁছোতে পারলেন না দেখা যাচ্ছে। তাতেও এমন কিছু ক্ষতি নেই। হুয়াসকার এসে
পৌঁছোলেও হুয়াইনা কাপাক-এর শবদেহ একবারের জন্যে প্রাণ পেয়ে জেগে উঠবে। উত্তরায়ণের শিশুসূর্য পূর্ব দিগন্তে আবির্ভূত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে একটি মহামন্ত্র অন্তত সমস্ত পেরুবাসীর কানে পৌঁছোবে। সে মহামন্ত্র তাভান্তিন্সুইয়ুর পবিত্র গিরিরাজ্য বিদেশি পাষণ্ডের পাপস্পর্শ থেকে মুক্ত করার।
হুয়াইনা কাপাক-এর শবদেহে প্রাণ-সঞ্চার কিন্তু আর হয় না। হঠাৎ কুজকো। শহরের দূর সীমা থেকে দ্রুত অগ্রসর একটা ধ্বনি শোনা যায়। সচকিত হয়ে ওঠে সমস্ত জনতা। হুয়াসকারই কি তা হলে এসে পৌঁছোলেন যথাসময়ে? কিন্তু এ তো তাঁর বাহিনীর পদশব্দ নয়। এ যে অশ্বক্ষুর-ধ্বনি
অশ্বক্ষুর-ধ্বনি মানে কী?
তার মানে তো হুয়াসকার-এর আহ্বান তাঁর পতাকাতলে সমবেত পেরুর শৃঙ্খলমোচনের বাহিনী নয়! নিশাবসানের তরল অন্ধকারে কুজকো শহরের দিগ্বিদকে যা তাভানতিনসুইয়ুর শঙ্কিত হৃদস্পন্দনের মতো শোনা যাচ্ছে, তা তো এসপানিওল। রিসালার আগমনবার্তা ছাড়া আর কিছু হতে পারে না। ঘোড়ার খুরের শব্দ একমাত্র বিদেশি শত্রু সওয়ারের নির্ভুল ইঙ্গিতই দেয়।
হঠাৎ এই মুহূর্তে এসপানিওল সওয়ার সৈনিক কি কামালকা থেকেই কুজকোতে আসছে? কেন?
কী হয়েছে তা হলে আতাহুয়ালপার? হুয়াসকারই বা কোথায়? কয়া কি তাঁকে মুক্ত করতে পারেনি?
দুর্ভাবনায় অস্থির হয়ে ওঠেন গানাদো। নির্ভুলভাবে সযত্নে সাজানো যেসব চাল অনিবার্যভাবে সাফল্যের শিখরে গিয়ে পৌঁছে দেবে ধরে রেখেছিলেন, তার মধ্যে কোনও একটা অপ্রত্যাশিতভাবে ব্যর্থ হয়ে গেছে।
কোন চালটা বিফল হয়েছে? কোথায়? কাক্সামালকায়, না কুজকোতে?
এসপানিওল সওয়ারবাহিনীর এই আকস্মিক হানা দেওয়ায় মনে হচ্ছে কাকসামালকাতেই কোনও কিছু ঘটেছে যা তাঁর হিসেবের বাইরে।
এসপানিওল সওয়ারবাহিনী এবার সূর্যবরণ প্রান্তরে এসে পৌঁছে গেছে। আতঙ্কবিহ্বল জনতা দিশাহারা হয়ে ঠেলাঠেলি করছে নিজেদের মধ্যে।