কিন্তু কয়া কুজকো ছেড়ে সৌসার পথে রওনা হতে পারলেও গানাদো তো তা আর পারেননি। ভিলিয়াক ভমুর প্রহরীদের দৃষ্টি এড়িয়ে কুজকো শহরে থাকাও তাঁর পক্ষে অসম্ভব।
সেই অসম্ভবই কিন্তু গানাদো সম্ভব করে তুলেছেন শুধু বুদ্ধির জোরে আর বেপরোয়া সাহসে। এ রাজ্যের মানুষের হাড়হদ্দ জানবার চেষ্টায় সত্যিই এমন এক লুকোবার আস্তানার হদিস তিনি পেয়েছেন সামনা সামনি দেখেও কুজকো শহরের কেউ যেখানে তাঁকে খোঁজবার কথা কল্পনাও করবে না।
দরকার শুধু সে আস্তানায় নিজেকে লুকোবার সাহস। গানাদোর সে সাহসের অভাব হয়নি।
সূর্যের দক্ষিণায়ন শেষ হবার সঙ্গে রেইমির উৎসব শুরু হবে পরের দিন। আগের বছর হুয়াসকার-ই ইংকা নরেশ হিসেবে এ উৎসবের প্রধান ভূমিকা নিয়েছিলেন। এবারে উৎসবে বিজয়ী নতুন ইংকা হিসেবে এ ভূমিকা যাঁর নেবার কথা তিনিও কামালকায় বিদেশি শত্রুর হাতে বন্দি।
রাজপুরোহিত ভিলিয়াক মুকেই তাই এবারের উৎসব অনুষ্ঠানে একাধারে ইংকা আর রাজপুরোহিতের দায়িত্ব নিতে হবে।
কুজকো নগরে কোরিকাঞ্চা ঘিরে সমবেত নাগরিক আর তীর্থযাত্রীরা বুঝি উদ্বিগ্ন হয়েছে। তাদের সোনার রাজ্যে একটা গভীর অমঙ্গলের ছায়া যে পড়েছে তা তাদের জানতে বাকি নেই। তবু যে তারা এ উৎসবে যোগ দিতে সব কিছু তুচ্ছ করে এসেছে তার কারণ শুধু অন্ধ ধর্মভীরুতা নয়। তাতিসুইয়ুর এই প্রধান ধর্মীয় অনুষ্ঠানে দেবাদিদেব আকাশপতি সূর্য তাঁদের কাতর প্রার্থনায় প্রসন্ন হয়ে তাদের পবিত্র রাজ্য থেকে পাপের ছায়া সরিয়ে নিতে পারেন এ আশাও একটু তাদের মনে আছে।
তারা উদ্বিগ্ন একটু হয়েছে পাছে অনুষ্ঠানের কোনও ত্রুটি হয় এই ভয়ে। ইংকা নরেশ হিসাবে হুয়াসকার বা আতাহুয়ালপা এ উৎসবে কোনও ভূমিকাই নিতে পারবেন না। কিন্তু ইংকা রাজশক্তির প্রতিনিধি হিসেবে যিনি এ উৎসব পরিচালনার দায়িত্ব নেবেন সেই রাজপুরোহিত ভিলিয়াক ভমুও যে কুজকো শহরে তখনও অনুপস্থিত।
কয়েকদিন আগে বিশেষ কোনও জরুরি প্রয়োজনে রাজপুরোহিত কুজকো ছেড়ে গেছেন তা তারা জানে। যেখানেই গিয়ে থাকুন, রেইমি উৎসবের দিন উত্তরায়ণের প্রথম সূর্যোদয়কে অভিনন্দিত করে অর্ঘসুরা বিতরণ করবার জন্যে কুজকোয় তিনি উপস্থিত থাকবেন নিশ্চয়।
কিন্তু রাত্রির শেষ যাম অতিক্রান্ত হতে চলেছে। পূর্ব দিগন্তের তারারা নিষ্প্রভ হয়ে আসছে। সে দিকের অন্ধকার তরল হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে, নগরসীমার পার্বত্য প্রান্তরে ভক্ত জনতা সমবেত হয়েছে মধ্যরাত্রি থেকে। অর্ঘ্যসুরার বিরাট পাত্র যথাস্থানে স্থাপিত হয়েছে অনেক আগেই। শুধু রাজপুরোহিতেরই তখনও দেখা নেই।
গত তিন দিন কোনও গৃহস্থ বাড়িতে আগুন জ্বলেনি, তিন দিন ধরে সমস্ত ভক্ত পেরুবাসীরা উপবাসী। পূর্বাকাশ প্রথম সূর্যকিরণ দেখবার সৌভাগ্যে ধন্য ও পবিত্র হবার জন্যে তারা দূরদূরান্তর থেকে এসে এই কৃচ্ছসাধন করেছে। স্বয়ং ইংকা নরেশ কি রাজপুরোহিত সেদিনের শিশুসূর্যকে প্রশস্তি মন্ত্রে বরণ না করলে তো সমস্ত অনুষ্ঠানই ব্যর্থ হয়ে যাবে। দেবাদিদেব পরমজ্যোতির আশীর্বাদের বদলে অভিশাপই বর্ষিত হবে সমস্ত তাভান্তিন্সুইয়ুর ওপর।
আকাশের দিকে আর নয়, জনতা ভীত উদ্বিগ্ন দৃষ্টিতে পিছনের নগরবর্জ্যের দিকে তাকায়, কোরিকাঞ্চার অধস্তন পুরোহিতদের উৎকণ্ঠিত দৃষ্টিও সেই দিকে। এত বড় বিশাল জনারণ্যকে একই আশঙ্কা যেন ঝড়ের মতো উদ্বেলিত করছে। অতি দীনদরিদ্র কৃষক থেকে যথার্থ ইংকা রক্তের অভিজাত সম্প্রদায় পর্যন্ত সকল শ্রেণীর আবালবৃদ্ধ নরনারীই তো সেখানে উপস্থিত। শুধু জীবিত নয়, মহান মৃতেরাও এসেছেন উত্তরায়ণের প্রথম সূর্যকে বন্দনা করতে।
ভাতিইয়ুর প্রাচীনতম প্রথা সত্যি পালিত হয়েছে এই দিনটির জন্যে। পেরু রাজ্যে মৃত ইংকাদের বিস্মৃতির অতলে হারিয়ে যেতে দেওয়া হয় না। অনেকটা মিশরের ধরনে তাঁদের মরদেহ শাশ্বত করে রাখবার চেষ্টা হয়। জীবনকালে যা পরতেন সেই জমকালো মহার্ঘ পোশাকে সাজিয়ে নিরেট সোনার সিংহাসনে কোরিকাঞ্চার সূর্যমন্দিরে সারিবদ্ধ তাঁদের শবদেহ বসানো থাকে। পরলোকগত ইংকাদের জন্যে একটি করে প্রাসাদও পৃথক ভাবে বরাদ্দ। সেখানে তাঁদের নিত্যব্যবহার্য জিনিস ও ঐশ্বর্য কোনও কিছুরই অভাব রাখা হয় না।
বিশেষ বিশেষ দিনে মৃত ইংকাদের শবদেহ তাঁদের ঐশ্বর্যবিলাসের উপকরণ সমেত এই কাজে নিয়োজিত স্বতন্ত্র প্রহরী ও অনুচরেরা জনসাধারণের সামনে এনে উপস্থিত করে। মৃত ইংকারা তখন জীবিতদের সমানই সশঙ্ক সমাদর পান।
সেই প্রথামতোই রেইমির উৎসব উপলক্ষে মৃত ইংকাদের সংরক্ষিত শবদেহ এনে রাখা হয়েছে নগর সীমার প্রান্তরে। পূর্বতন ইংকাদের মধ্যে হুয়াসকার ও আতাহুয়ালপা দু-জনেরই পিতা হুয়াইনা কাপাক-এর শবদেহকে ঘিরে ঐশ্বর্যগরিমার সমারোহ সবচেয়ে বেশি। পেরুর প্রজাসাধারণের মনে ইংকা হুয়াইনা কাপাক-এর। স্মৃতি এখনও অত্যন্ত উজ্জ্বল। সোনার সিংহাসনে বসানো, সোনারুপোর কাজে ঝলমল পোশাকে সাজানো তাঁর শবদেহের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় ইংকা প্রজারা সসম্ভ্রমে তাঁকে অভিবাদন জানিয়ে যায়। তাদের কাছে তিনি মৃত নন। রাজপুরোহিত যথাসময়ে না এসে পৌঁছোবার দরুন রেইমি উৎসব যে পণ্ড হতে চলেছে তার জন্যে তিনিও গভীরভাবে উৎকণ্ঠিত বলেই তাদের ধারণা। পূর্ব দিগন্ত আরও পাণ্ডুর হয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে শঙ্কিত ব্যাকুলতায় তারা অনেকে হুয়াইনা কাপাক-এর কাছেই নিজেদের প্রার্থনা জানায়। যথাবিহিত অনুষ্ঠান না হলে সূর্যদেবের যে অভিশাপ সমস্ত তাভানতিসুইয়ুতে বর্ষিত হতে পারে তা থেকে শেষ মুহূর্তে তিনিই রক্ষা করতে পারেন এই তাদের অন্ধ বিশ্বাস।