রাজপুরোহিতের গুপ্ত প্রহরীর চেয়ে অনেক বেশি উৎকণ্ঠিত কৌতূহল নিয়ে থলিটি থেকে অভিজ্ঞানের নিদর্শনগুলি সে বার করে এনেছিল।
তারপর প্রহরীর চেয়ে অভিভূত হয়ে সেদিক থেকে আর দৃষ্টি ফেরাতে পারেনি।
অভিজ্ঞান হিসেবে এমন কিছু তখন তার হাতে শোভা পাচ্ছে, যা তারও কল্পনাতীত।
এ কল্পনাতীত অভিজ্ঞান নিদর্শন হল কোরাকেঙ্কুর দুটি পালক আর উদয়সূর্যের মতো রক্তিম ইংকা নরেশের শিরোশোভা প্লান্টুর একটি টুকরো।
ইংকা নরেশের প্রত্যক্ষ উপস্থিতির চেয়ে তাঁর অখণ্ড আধিপত্যের এ কটি নিদর্শনের মূল্য কম নয়। কোরাকেঞ্জুর এ পালক পেরুর বিরলতম বস্তু। তাভান্তিন্সুইয়ুর অতিগোপন দুর্গম একটি মরুশুষ্ক সর্বসাধারণের নিষিদ্ধ অঞ্চলে কোরাকেষ্ণু নামে আশ্চর্য একটি পক্ষীজাতি যুগ যুগ ধরে সযত্নে লালিত হয়ে আসছে। পোষা দুরে থাক, সে পাখি চোখে দেখবার অধিকারও পেরুর প্রজাসাধারণের নেই। অভিষেকের সময়ে সেই পাখির দুটি মাত্র পালক প্রত্যেক ইংকাকে শিরোভূষণ হিসেবে দেওয়া হয়। কোরাকেঞ্জুর সেই পালক আর বিশেষ ভিকুনার পশমে বোনা মাথায় জড়াবার রক্তিম বস্ত্র প্লান্টু ইংকা রাজশক্তির সবচেয়ে সম্মানিত প্রতীক। আর যা-কিছুরই হোক, কোরাকেঞ্জুর এ পালকের জাল হওয়া অসম্ভব। স্বয়ং ইংকা নরেশের মতো এ পালক দ্বিতীয়রহিত। রাজশক্তির প্রতীক হিসেবে তাই এ নিদর্শন সমস্ত সন্দেহ সংশয়ের ঊর্ধ্বে।
এ প্রতীক চিহ্ন আতাহুয়ালপার কাছে গোপনে চেয়ে নিয়ে গানাদো আশ্চর্য দূরদৃষ্টির পরিচয় দিয়েছিলেন সন্দেহ নেই। এ প্রতীকচিহ্ন আতাহুয়ালপার কাছে আদায় করা অবশ্য সহজ হয়নি। গানাদোর ওপর আতাহুয়ালপার বিশ্বাস তখন গভীর, তবু এ প্রস্তাব শুনে রীতিমতো স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছিলেন আতাহুয়ালপা। তীক্ষ্ণ অবিশ্বাসের সুরে সবিস্ময়ে গানাদোর দিকে চেয়ে বলেছিলেন, কী, বলছ কী তুমি! কোরাকেঙ্কুর পবিত্র পাখির পালক আমি তোমার হাতে তুলে দেব প্রতীক-চিহ্ন হিসেবে চরম সংকটে ব্যবহার করবার জন্যে।
হ্যাঁ, সূর্যসম্ভব। দৃঢ়স্বরে বলেছিলেন গানাদো, আর সবকিছু যেখানে বিফল, সেখানে অসাধ্যসাধনের জাদুদণ্ড হিসেবে এই পালকে যে কাজ হবে, আর কিছুতে তা হবার নয়।
কিন্তু, ক্ষুব্ধ প্রতিবাদ জানিয়ে বলেছিলেন আতাহুয়ালপা, এ তো আমাদের সমস্ত সংস্কার আর ঐতিহ্যের অপমান! ভাতিসুয়ুইর ইতিহাসে এ পবিত্র প্রতীক কোনওদিন কোনও ইংকা নরেশের হাতছাড়া হয়নি।
শান্তকণ্ঠে একটি উত্তর দিয়েই আতাহুয়ালপাকে নীরব করে দিয়েছিলেন গানাদো। বলেছিলেন, তাভানতিসুইয়ুর ইতিহাসে এমন চরম লজ্জার আর দুর্ভাগ্যের দিনও কখনও আসেনি।
পরিকল্পনায় ভুল হয়নি গানাদোর। চরম সংকটে অলৌকিক জাদুদণ্ডের মতোই কাজ করেছে ইংকা নরেশের প্রতীক-চিহ্ন।
রাজপুরোহিত ভিলিয়াক ভমু নতমস্তকে সে প্রতীকচিহ্ন মেনে নিয়ে চলে গেছেন। হুয়াসকার এবার মুক্তি পাবেন।
২৫. সূর্যদেবের উত্তরায়ণ
পরের দিন থেকেই সূর্যদেবের উত্তরায়ণের সঙ্গে রেইমি-র উৎসব শুরু হবে। কাস্লামালকা শহরে আতাহুয়ালপা নিশ্চয়ই প্রস্তুত হয়ে আছে সম্পূর্ণভাবে। রেইমি উৎসবের সুযোগ নিয়ে আনন্দমত্ত জনতার মধ্যে নিজেকে গোপন করে সৌসার পথে তিনি রওনা হবেন। ওদিকে হুয়াসকারও তখন সৌসায় বসে থাকবেন। পার্বত্যপথের এক গোপন দুর্গে দুই রাজভ্রাতার সাক্ষাতের ব্যবস্থা সম্পূর্ণ হয়ে আছে। বিদেশি শত্রুদের যা ভাতিনসুয়ুইর পবিত্র গিরিরাজ্য থেকে ঘৃণ্য ক্লেদের মতো ধুয়ে দূর করে দেবে পেরুর সে নবজাগরণের ঢল নামতে শুরু করবে ওই গোপন দুর্গ থেকেই।
ভিলিয়াক ভূমুর সমস্ত পাহারাদারদের চোখে ধুলো দিয়ে গানাদো সেই পরম মুহূর্তের অপেক্ষায় কুজকো শহরেই এমন এক অবিশ্বাস্য গোপন আশ্রয় খুঁজে নিয়েছেন, সমস্ত কুজকোবাসীর প্রায় চোখের ওপরে থেকেও, যা তাদের কল্পনাতীত।
অপেক্ষা আর কটা দিন মাত্র, অধৈর্য নেই তাই গানাদোর মনে। কামালকায় কী হচ্ছে তা যেন তিনি মনশ্চক্ষে দেখতে পান। যা দেখতে পান।
তা হল এই যে, এসপানিওল সেনাপতি পিজারোর সঙ্গে কাক্সামালকা শহরের নতুন এক আগন্তুক গভীর উত্তেজিত আলোচনায় মত্ত। সে আগন্তুকের নাম মার্কুইস গঞ্জালেস দে সোলিস।
সৌসা কারাদুর্গের একটি ঘটনাও তখন গানাদোর কল্পনার বাইরে।
কোরাকেঙ্কুর পালক দেখিয়ে সৌসা দুর্গে কয়া যখন সমস্ত সন্দিগ্ধ অভিযোগের জবাব দিয়ে রাজপুরোহিতের কুটিল গোপন চক্রান্ত ব্যর্থ করে দিয়েছে, আর কামালকা নগরে পেরু বিজয়ী এসপানিওল সেনাপতি পিজারোর সঙ্গে স্মরণীয় সাক্ষাৎ হয়েছে মার্কুইস গঞ্জালেস দে সোলিস-এর, গানাদো নিজে তখন কুজকো শহরেই দিন নয়, দণ্ডপল গুনছেন।
সমস্ত তাভানতিনসুইয়ু যাতে কেঁপে উঠবে সে বিস্ফোরণের আর বিলম্ব হবার কথা নয়। হাওয়ায় তিনি উগ্রীব কান পেতে আছেন সৌসা থেকে প্রথম সে জয়ধ্বনি শোনবার জন্যে।
কিন্তু কান তিনি পেতে আছেন কোথায়?
নেহাত জাদুমন্ত্রে কীটপতঙ্গ না হয়ে থাকলে কুজকো শহরে তাঁর লুকিয়ে থাকা তো অসম্ভব। রাজপুরোহিত ভিলিয়াক ভূমুর প্রকাশ্য প্রহরী ও গোপন চরেরা বাড়ি ঘর রাস্তাঘাট তো তন্নতন্ন করে খুঁজেছে-ই, রেইমি উৎসবের জন্যে সমবেত তীর্থযাত্রীদেরও জনে জনে পরীক্ষা করবার ত্রুটি রাখেনি। ভিলিয়াক ভমু সৌসা রওনা হবার আগে সেই আদেশই দিয়ে গিয়েছিলেন। কুজকো থেকে বাইরে যাবার গোনাগুনতি পাহাড়ি রাস্তা তো আগেই বন্ধ করবার ব্যবস্থা হয়েছিল। গানাদো তাঁর সঙ্গে দেখা করে চলে যাবার পর তাঁকে অতিথিশালায় গিয়ে বন্দি করার আদেশের সঙ্গে কুজকো থেকে যাবার-আসবার পথগুলিতে কড়া পাহারার ব্যবস্থা রাজপুরোহিত করেছিলেন। নেহাত স্ত্রীলোক বলেই কয়া সে পাহারা এড়িয়ে কিছুদূর পর্যন্ত বিনা বাধায় যেতে পেরেছিল। গানাদোর সম্বন্ধেই সতর্ক হওয়া দরকার মনে করে মেয়েদের সম্বন্ধেও হুঁশিয়ার থাকবার নির্দেশ দেবার কথা রাজপুরোহিতের মাথায় আসেনি। রাজপুরোহিতের এই হিসেবের ভুলটুকু অনুমান করেই গানাদো কয়াকে একা অত বড় কঠিন বিপদের কাজে পাঠিয়েছিলেন নিশ্চয়।