হুয়াসকার একটু হেসে এ উত্তেজিত ভাষণে বাধা দিয়েছেন, আপনি বলতে চান এ মেয়েটি সেই রকম বিদেশি শত্রুর চর!
হ্যাঁ, তাই বলতে চাই!—হুয়াসকারের কৌতুকের স্বরে রাজপুরোহিত আরও উত্তেজিত হয়েছেন—মুইস্কা কুমারী বলে ও নিজের পরিচয় দিচ্ছে। ইংকা আর মুইস্কা কোনও পরিবারেরই কুলপঞ্জি আমাদের অজানা নয়। কোথাকার কোন মুইস্কা বংশে ওর জন্ম আমি জানতে চাই। জানতে চাই এই বয়সে এই কঠিন দৌত্যের ভার ও কেমন করে পেল!
রাজপুরোহিতের এ তীব্র আক্রমণের সামনে মেয়েটি যেন একটু বিবর্ণ হয়ে উঠেছে, লক্ষ করেছেন হুয়াসকার।
রাজপুরোহিতের দৃষ্টিতেও তা এড়ায়নি। আরও নির্মম তীব্রতার সঙ্গে তিনি জিজ্ঞাসা করেছেন, নিজের কোনও নাম এ পর্যন্ত ও যে জানায়নি তা লক্ষ করেছেন? নিজের নামটুকু জানাতে কেন ওর এ দ্বিধা।
দ্বিধা হবে কেন! মেয়েটির একেবারে পার হয়ে আসা মুখের দিকে চেয়ে স্বতস্ফুর্ত মমতায় তার পক্ষ নিয়ে বলেছেন হুয়াসকার, নাম বলার প্রয়োজন হয়নি বলেই বলেনি। একটু থেমে সাহস দিয়ে বলেছেন আবার, বলল, কী নাম তোমার?
মেয়েটি বিপন্ন কাতর দৃষ্টি মেলে হুয়াসকার-এর দিকে নীরবে চেয়ে থেকেছে শুধু। কিছুই বলতে পারেনি।
বলল, তোমার নাম। একটু বিমূঢ় স্বরে হুয়াসকার আবার তাকে উৎসাহ দেবার চেষ্টা করেছেন।
হিংস্র উল্লাসে দীপ্ত হয়ে উঠেছে রাজপুরোহিতের মুখ। নিষ্ঠুর শাণিত দৃষ্টিতে যেন শিকারকে বিদ্ধ করে তিনি বলেছেন, নাম ও বলবে না। কারণ ও জানে মিথ্যা নাম দিয়ে ও পরিত্রাণ পাবে না। শুধু নামটুকু পেলেই কুলজি মিলিয়ে ওর প্রতারণা আমি প্রমাণ করে দেব। নাম বলবার সাহস তাই ওর নেই।
নিশ্চয় আছে। এতক্ষণে একটু অধৈর্য প্রকাশ পেয়েছে হুয়াসকার-এর কণ্ঠে। স্নেহের স্বরে বলেছেন, বলো, তোমার নাম, দ্বিধা কোরো না।
এখনও কি নীরব থাকবে মেয়েটি!
হুয়াসকার উদ্বিগ্নভাবে তার মুখের দিকে তাকিয়েছেন। রাজপুরোহিত তাকিয়েছেন হিংস্র ব্যাধের দৃষ্টিতে।
মেয়েটির ঠোঁটদুটি বারকয়েক কেঁপে উঠেছে। তারপর অস্ফুট স্বরে সে যা বলেছে তাতে বিমূঢ় জিজ্ঞাসা ফুটে উঠেছে হুয়াসকার-এরও চোখে আর রাজপুরোহিতের কণ্ঠে একটা তীক্ষ্ণ বিদ্রূপের হাসি।
আমার নাম কয়া, বলেছে মেয়েটি।
কয়া!সবিস্ময়ে তার দিকে তাকিয়ে নিজের মনেই যেন কথাটা উচ্চারণ করেছেন হুয়াসকার।
এ নাম এ দেশের কোনও কুমারী মেয়ের হওয়া সম্ভব? বিদ্রূপের সঙ্গে একটা তীব্র অভিযোগ ফুটে উঠেছে রাজপুরোহিতের গলায়—তোমায় এ নাম দেবার স্পর্ধা কোন পরিবারের হয়েছে?
কী বলবে কয়া? এ নাম কোথায় কে তাকে দিয়েছে স্বীকার করবে? প্রকাশ করবে তার চরম কলঙ্কের কথা? সে যে কন্যাশ্রম থেকে লুণ্ঠিতা সূর্বসেবিকা, সূর্যসেবিকা হিসেবে কোনও নাম যে তার কোনওদিন ছিল না, তার জীবনে অভাবিত মুক্তির দূত হয়ে যে দেখা দিয়েছে, এ নাম যে উদয়-সমুদ্রতীরের সেই আশ্চর্য পুরুষের দেওয়া, সবিস্তারে জানাবে কি সে কাহিনী?
কী তার ফল হবে সে ভাল করেই জানে। আর যারই থাক, ভ্রষ্টা সূর্যকুমারীর কোনও ক্ষমা নেই তাভান্তিন্সুইয়ুতে। ইতিহাস যাই হোক, কেউ তার কোনও মূল্য দেবে না। আপামর সকলের সে ঘৃণা ও অবিশ্বাসের পাত্রী। স্বয়ং সূর্যদেবের অভিশাপে ছাড়া সূর্যকুমারী কখনও ভ্রষ্টা হতে পারে না, এ রাজ্যের এই দৃঢ়বিশ্বাস। কারও সহানুভূতি সে পাবে না। পাপাচারিণী বলে চিহ্নিত হয়ে তার পক্ষে প্রতারণাই স্বাভাবিক বলে সবাই ধরে নেবে।
এমন আশ্চর্য কৌশলে, এত দুঃসাহসে ও অবিশ্বাস্য চেষ্টায় সাজিয়ে তোলা আয়োজন কি শুধু তার জন্যেই ব্যর্থ হয়ে যাবে তা হলে?
কুজকো থেকে সৌসায় এসে হুয়াসকার-এর সাক্ষাৎ পাওয়ার মতো অসাধ্যসাধনের পর সার্থকতায় পৌঁছোবার সেতু ভেঙে পড়বে শেষমুহূর্তে। হুয়াসকার তাকে অবিশ্বাস করবেন? দুই রাজভ্রাতার মিলন আর হবে না? বিদেশি শত্রুর কলুষমুষ্টি থেকে তাভান্তিন্সুইয়ু উদ্ধারের সব আশা শূন্যে বিলীন হয়ে যাবে এক মুহূর্তে?
কয়ার পায়ের তলায় কঠিন মাটি যেন দুলে উঠেছে। সেই অবস্থাতেই হুয়াসকার-এর বজ্রকঠিন স্বর সে শুনতে পেয়েছে।
হুয়াসকার যা বলছেন তা আশাতীত অবিশ্বাস্য।
শুনুন, ভিলিয়াক ভমু। কঠিন স্বরে বলেছেন হুয়াসকার, কয়া নামে নিজের পরিচয় যে দিচ্ছে, সেই মুইস্কা বংশের কেউ না হতে পারে। কিন্তু পরিচয় ও ইতিহাস যাই হোক, আতাহুয়ালপার দূতী হিসেবে তাকে অবিশ্বাস করবার কোনও অধিকার আমাদের নেই। অন্য সবকিছু মিথ্যা হলেও তার দৌত্যের মধ্যে যে প্রতারণা নেই, তার পরম সন্দেহাতীত প্রমাণ সে দিয়েছে। বুঝতেই পারছেন, সে প্রমাণ না দিতে পারলে কুজকো থেকে গুপ্ত গিরিপথে সৌসায় আসা তার পক্ষে সম্ভব হত না আর সৌসার এ কারাদুর্গের নির্মম প্রহরীরাও দেবীর সম্মান দিয়ে আমার কাছে তাকে উপস্থিত হবার সুযোগ দিত না।
বুঝতে সবই পারছি! দাঁতে দাঁত চেপে বলেছেন রাজপুরোহিত, কিন্তু এত সব অসাধ্যসাধন যা করেছে সেই আশ্চর্য প্রমাণটা চাক্ষুষ একবার দেখতে চাচ্ছি।
তা-ই দেখুন। এবার হেসে বলেছেন হুয়াসকার।
কয়া ধীরে ধীরে ভিকুনার পশমে বোনা থলিটি এবার খুলে ধরে যা বার করে এনেছে সেদিকে চেয়ে স্তব্ধ হয়ে গেছেন রাজপুরোহিত।
রাজপুরোহিতের মুখেই শুধু যে কথা সরেনি তা নয়, তাঁর চোখদুটো যেন কোটর থেকে ঠেলে বেরিয়ে এসেছে বিমূঢ়-বিস্ময়ে।