পাউলো টোপার বেলা যা বিফল হয়েছে ওই মুইস্কা মেয়েটির বেলা তা সফল হতে বাধ্য। শুধু উৎপীড়নের ভয় দেখিয়েই মেয়েটির কাছে কথা যা আদায় করবার করা যাবে নিশ্চয়। তা ছাড়া তাকে টোপ করে গানাদোর মতো ধুরন্ধরকে ধরা হয়তো শক্ত হবে না। ইতিপূর্বে এ কৌশলটা কেন মাথায় আসেনি ভেবে আফশোশ হয়েছে। রাজপুরোহিতের।
এইবার মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ার মতো সবচেয়ে অপ্রত্যাশিত ঘা খেয়েছেন রাজপুরোহিত। মুইস্কা মেয়েটি কোথায় আশ্রয় নিয়েছে তা তাঁর জানা। দূর-দূরান্তরের তীর্থযাত্রিণীদের সেই অতিথিশালায় কিন্তু তাকে পাওয়া যায়নি। জানা গেছে যে গানাদো যেদিন থেকে নিরুদ্দেশ মেয়েটিকেও সেই দিন থেকে অতিথিশালায় আর দেখা যায়নি। তীর্থযাত্রিণীদের অতিথিশালায় থাকা না থাকা তাদের স্বেচ্ছাধীন বলেই এ বিষয়ে সন্দেহ করবার কিছু পায়নি কেউ।
মুইস্কা মেয়েটি কি তা হলে গানাদোর সঙ্গেই কুজকো শহরে রেইমি উৎসবের ভিড়ে আত্মগোপন করে আছে?
রাজপুরোহিত তাঁর অনুচরদের প্রাণপণে এ দুজনের সন্ধান করতে বলেছেন। নিজে কিন্তু তিনি এ সন্ধানের ফলাফলের জন্যে অপেক্ষা করেননি। তাতিসুইয়ুর প্রধান পুরোহিত হয়েও চিরদিনের বিধি লঙ্ঘন করে রেইমি উৎসবের আগেই দুজন বিশ্বাসী অনুচর নিয়ে তিনি কোরিকাঞ্চা শুধু নয়, কুজকো শহরই গোপনে ত্যাগ করেছেন।
কী তাঁর গন্তব্য তা অনুমান করা কঠিন নয়। হুয়াসকার যেখানে বন্দি সেই সৌসা দুর্গই তাঁর লক্ষ্য।
প্রথমে যত অস্থির উত্তেজিতই হয়ে থাকুন, রওনা হবার পর রাজপুরোহিতের মনে বিশেষ কোনও উদ্বেগ আর থাকে না। অসম্ভবও যদি সম্ভব হয়ে থাকে তবু তাঁর ভাবনা করবার কিছু নেই। কুজকো থেকে সৌসায় এমন গুপ্ত গিরিপথ আছে যা ডাক হরকরাদেরও অজানা। সে গুপ্তপথের বিশেষ দিশারি রক্ষী আছে। ইংকা নরেশ, সেনাপতি ও রাজপুরোহিত, এই তিন ইংকা শ্রেষ্ঠ ও তাঁদের চিহ্নিত কোনও প্রতিনিধিকে ছাড়া আর কাউকে এ পথ চিনিয়ে তারা নিয়ে যাবে না। সুতরাং সাধারণ সরকারি রাস্তায় যদি কেউ সমস্ত সতর্ক পাহারা এড়িয়ে গিয়ে যেতে পেরেও থাকে। তবু তার অনেক আগে তিনি গুপ্তপথে সৌসায় পৌঁছে যাবেন।
হুয়াসকার-এর কাছে আতাহুয়ালপার প্রস্তাবই কোনওদিন আর পৌঁছোবে না!
যা অসম্ভব অবিশ্বাস্য তাই কিন্তু ইতিমধ্যে ঘটে গেছে। কন্যাশ্রমের বাইরের পৃথিবী। যার কাছে চন্দ্রলোকের মতো অজানা, শিশিরস্নিগ্ধ তেমনই একটি অবলা সরলা মেয়ে অসাধ্য সাধন করে আতাহুয়ালপার প্রস্তাব সত্যিই পৌঁছে দিয়েছে হুয়াসকার-এর কাছে।
শুধু গুপ্ত গিরিপথই তার কাছে উন্মুক্ত হয়ে যায়নি, সৌসার সদাসতর্ক প্রহরীরা। তাকে বাধা দেবার বদলে সসম্রমে অভ্যর্থনা করেছে, আর হুয়াসকার-আতাহুয়ালপার দূতী হিসেবে তাকে অবিশ্বাস করবার কথা কল্পনাও করেননি।
এ অলৌকিক ব্যাপার কেমন করে সম্ভব হল?
রাজপুরোহিত সৌসায় পৌঁছে স্তম্ভিত হয়ে সেই প্রশ্নেরই উত্তর খুঁজেছেন।
সৌসা দুর্গে উপস্থিত হবার পর প্রথমেই তিনি হুয়াসকার-এর সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে গেছলেন। সেখানে প্রেতমূর্তি দেখবার মতো তিনি চমকে উঠেছেন। সেই মুইস্কা মেয়েটিকে আর যেখানে তোক হুয়াসকার-এর কাছে দেখবার কথা তিনি কল্পনাও করতে পারেননি। ভেতরে ভেতরে যত বিচলিতই হোন, বাইরে নিজেকে সম্পূর্ণ সংযত রেখে হুয়াসকার-এর মুখে আতাহুয়ালপার প্রস্তাবের কথা ধৈর্য ধরে তিনি দ্বিতীয়বার শুনেছেন। হুয়াসকার যে এ প্রস্তাবে সম্পূর্ণ সম্মত তা বুঝতে রাজপুরোহিতের দেরি হয়নি!
সব কিছু শোনবার পর প্রথমেই তাই তিনি প্রশ্ন করেছেন, এ প্রস্তাব স্বয়ং আতাহুয়ালপাই পাঠিয়েছেন বলে আপনি বিশ্বাস করেন?
এ রকম প্রশ্নে বেশ একটু বিস্মিত হয়ে হুয়াসকার বলেছেন, নিশ্চয় করি! শুধু ওই কিপুটি দেখে? চেষ্টা করেও রাজপুরোহিত তাঁর গলার স্বর সম্পূর্ণ স্বাভাবিক রাখতে পারেননি, কেমন করে জানছেন যে ও কিপু জাল নয়? এই সম্পূর্ণ অজানা মেয়েটি যে আমাদের প্রতারণা করতে আসেনি তার প্রমাণ কী?
যার চেয়ে বড় প্রমাণ আর হতে পারে না সেই প্রমাণই ও দিয়েছে? হুয়াসকার গভীর বিশ্বাসের সঙ্গে একটু হেসে বলেছেন, তা ছাড়া ওর দিকে একবার চেয়ে দেখলেই বুঝবেন, তাভান্তিন্সুইয়ু-র পবিত্রতম গিরিসাগর টিটিকাকার জলের মতো অন্তর ওর স্বচ্ছ। কোনও প্রমাণ ছাড়াই বিশ্বাস করা যায় যে সেখানে প্রতারণা থাকতে পারে না।
শুধু ওই রূপ দেখেই তা হলে ভুলেছেন? রাজপুরোহিত ভিলিয়াক ভমুর গলা তিক্ত বিদ্রূপে একটু তীক্ষ্ণ হয়েছে—ওর মুখে ইংকা রাজভাষা শুনে মনে করেছেন।
ও সত্যিই মুইস্কা বংশের কুমারী।
মুইস্কা বা ইংকা না হলে এ ভাষা তো কারও পক্ষে জানা সম্ভব নয়।– রাজপুরোহিতের অন্যায় সন্দেহে একটু কৌতুকই বোধ করেছেন হুয়াসকার—তা ছাড়া ওর বংশপরিচয়ের কথা এখানে অবান্তর নয়?
না, নয়। জোর দিয়ে বলেছেন রাজপুরোহিত, মিথ্যা বংশপরিচয়ের মধ্যেই ওর প্রতারণার সুস্পষ্ট প্রমাণ। ইংকা রাজভাষা ওর মুখে শুনে ভুলবেন না। যেদিন থেকে এ পবিত্র দেশ বিদেশি পাষণ্ডদের পায়ের স্পর্শে কলুষিত হয়েছে সেদিন থেকে মানুষের বুকে সত্যের আর ধর্মের দীপ নিভে গেছে। কুইচুয়ার বদলে পবিত্র রাজভাষা অশুচি জিহ্বায় উচ্চারণ করতে সাধারণ প্রজার আর বুক কাঁপে না। বিদেশি পাষণ্ডরা দেশদ্রোহী এ দেশের কুলাঙ্গারদের এ-ভাষা শেখবার সুযোগ করে দিচ্ছে চর হিসেবে নিয়োগ করবার জন্যে।