গানাদো ফিরে দাঁড়িয়ে এক পা বাড়াবারও সময় পাননি। কয়া এসে তাঁর হাত ধরে ফেলেছে।
পরস্পরের মুখের দিকে চেয়ে দুজনের কেউই কিছুক্ষণ কোনও কথা বলতে পারেননি। হাতও ছাড়েননি কেউ কারও।
কয়াই স্নিগ্ধ স্বরে প্রথমে বলেছে, ও থলি আমায় দাও।
চোখ তার সজল, মুখে অদ্ভুত একটি হাসি।
এ থলি নিয়ে কী হবে, কয়া? গলার স্বর অকম্পিত রাখবার চেষ্টা করেছেন গানাদো—তোমায় যেতে দিতে আমি পারি না। উদয় সাগরের তীরের মানুষ হয়ে তোমায় একবার উদ্ধার করবার সৌভাগ্য আমার হয়েছে বলে তোমার মৃত্যুদণ্ড আমার হাতে নেই। তোমার পিতামহের গণনাই নিষ্ফল।
তাঁর গণনার কতটুকু আর তুমি জানো! বিষগ্ন একটি হাসি মুখে নিয়ে বলেছে কয়া—মনে করা তাঁর গণনা সফল করতেই আমায় যেতে হবে। তা ছাড়া সূর্যকন্যা হিসেবে স্রষ্টা বলে তাভান্তিন্সুইয়ুর জন্যে প্রাণ দেবার অধিকারও কি আমার নেই?
এর উত্তরে আর কিছু বলতে পারেননি গানাদো। নীরবে অভিজ্ঞানের থলিটি কয়ার হাতে ফিরিয়ে দিয়েছেন।
ফিরিয়ে দিয়ে আর সেখানে দাঁড়াননি।
২৩. অনুমান ভুল হয়নি গানাদোর
অনুমান ভুল হয়নি গানাদোর। যে অতিথিশালায় সোনাবরদার হিসেবে তাঁরা। আশ্রয় পেয়েছিলেন তার দরজায় সত্যিই রাজপুরোহিতের অনুচর প্রহরীরা তখন খাড়া হয়ে আছে।
রাজপুরোহিতের সূর্যবেদিকার কক্ষ থেকে বার হয়ে সে আস্তানায় ফিরে গেলে এ প্রহরীদের সঙ্গে তাঁর দেখা হত। রাজপুরোহিত বেশিক্ষণ অপেক্ষা করেননি। গানাদো বিদায় নিয়ে চলে যাবার খানিক বাদেই তাঁর অনুচরদের পাঠিয়েছেন।
অনুচর প্রহরীরা অতিথিশালায় এসে জোর-জুলুম কিছু করেনি। অত্যন্ত সম্ভ্রমের সঙ্গেই সোনাবরদারদের নায়ক গানাদোর কাছে রাজপুরোহিতের একটা অনুরোধ জানাতে চেয়েছে। রাজপুরোহিত বিশেষ জরুরি কোনও প্রয়োজনে গানাদোর সঙ্গে এখনই আর একবার দেখা করতে চান। প্রহরীরা তাই গানাদোকে সসম্মানে নিয়ে যেতে এসেছে।
কিন্তু গানাদো তো এখানে নেই! অতিথিশালা থেকে বেরিয়ে এসে পাউলো টোপাই প্রহরীদের প্রধানকে বলেছেন, তিনি তো রাজপুরোহিতের সঙ্গেই দেখা করতে গেছেন।
হ্যাঁ, গেছলেন? বিমূঢ়ভাবে বলেছে প্রহরী-প্রধান, দেখা শেষ করে চলেও এসেছেন অনেক আগে। এতক্ষণে তো তাঁর এখানেই ফিরে আসবার কথা।
ফিরে কিন্তু গানাদো আসেননি। নিরুপায় হয়ে প্রহরী-প্রধান পাউলো টোপাকেই রাজপুরোহিতের কাছে নিয়ে গেছে। পাহারায় দাঁড় করিয়ে গেছে কয়েকজন
অনুচরকে গানাদো যদি ফিরে আসেন সেই ভরসায়।
প্রহরীদের দাঁড়িয়ে থাকা-ই সার হয়েছে। গানাদোর দেখা তারা পায়নি। ওদিকে পাউলো টোপাকে তখন অস্থির হয়ে উঠতে হচ্ছে রাজপুরোহিতের জেরায়।
গানাদো এখনও অতিথিশালায় ফেরেননি কেন? এখান থেকে আর কোথায় তাঁর পক্ষে যাওয়া সম্ভব?
পাউলো টোপা সরলভাবেই এ বিষয়ে তাঁর অজ্ঞতা জানিয়েছেন। তাতে রেহাই মেলেনি এবং আরও কঠিন প্রশ্নের মুখে পড়তে হয়েছে।
বিদেশি শত্রুদেরই একজন হওয়া সত্ত্বেও গানাদো তাঁদের দলপতি হয়েছেন কী করে?
আতাহুয়ালপার এত গভীর বিশ্বাস তাঁর ওপর কেমন করে জন্মাল যে তাঁরই পরামর্শ নিয়ে এমন বিপজ্জনক ষড়যন্ত্রের মধ্যে নিজেকে জড়িয়েছেন?
পাউলো টোপা এসব প্রশ্নের উত্তর যতটুকু জানতেন তাও দেননি। রাজপুরোহিতের গলার স্বর আর চোখের দৃষ্টিতে এমন কিছু তিনি পেয়েছেন যা তাঁকে সতর্ক করে দিয়েছে। তিনি জানিয়েছেন যে, ইংকা নরেশ আতাহুয়ালপার আদেশ পালনই করতে সোনাবরদার দলের সঙ্গে তিনি এসেছেন। গানাদো সম্বন্ধে কোনও প্রশ্নের উত্তর দেবার ক্ষমতা তাঁর নেই।
রাজপুরোহিত বিশ্বাস করেননি সে কথা। পাউলো টোপার কাছ থেকে কোনও কথা বার করতে না পেরে শেষ পর্যন্ত তাঁকে বন্দি করেছেন। সেই সঙ্গে প্রহরীদের আদেশ দিয়েছেন যেমন করে তোক গানাদোকে খুঁজে আনবার।
গানাদোকে কিন্তু খুঁজে পাওয়া যায়নি। কোরিকাঞ্চার মন্দির-নগর তোলপাড় করে ফেলেছে রাজপুরোহিতের অনুচরেরা। সেখানে অন্তত তিনি নেই।
কোরিকাঞ্চায় না থাকলে কুজকো নগরেই কোথাও তিনি গা ঢাকা দিয়ে আছেন নিশ্চয়। সেইখানেই তাঁর খোঁজ করা দরকার। কিন্তু কুজকো শহরে তাঁর সন্ধান করা বেশ একটু কঠিন হয়ে পড়েছে তখন রেইমি-র উৎসবের দরুন।
সূর্যদেবের উত্তরায়ণ একেবারে আসন্ন। রেইমির উৎসবের আয়োজন তার আগে থাকতেই শুরু হয়ে গেছে। দূর-দূরান্তর থেকে এ উৎসবে যোগ দিতে যারা কুজকোয় এসে জড়ো হয়েছে তাদের ভিড়ে নগরে চলাফেরাই দায় হয়ে দাঁড়িয়েছে।
লুকিয়ে থাকতে চাইলে এ জনারণ্যে কাউকে খুঁজে বার করা অসম্ভব।
গানাদোর খোঁজ না পেয়ে অত্যন্ত অস্থির উত্তেজিত হয়ে উঠেছেন রাজপুরোহিত। গানাদো কি তা হলে কুজকো ছেড়ে সৌসার দিকেই গেছে? না, তা অসম্ভব। প্রথম দিন থেকেই সৌসার পথে তিনি কড়া পাহারা রেখেছেন।
তাঁর কাছে আতাহুয়ালপার দূতী হয়ে যে এসেছিল সেই মুইস্কা মেয়েটির কথা এবার মনে পড়েছে তাঁর। দলপতি গোছের কারও সাহায্য ও নির্দেশ না পেলে তার মতো অবলা অসহায় একটি মেয়ের যে কিছু করবার ক্ষমতা নেই তা জেনেই এ পর্যন্ত তাকে হিসেবের মধ্যে ধরেননি।
এবার কিন্তু তাকেও প্রয়োজন মনে হয়েছে। পাউলো টোপা চরম উৎপীড়নেও কোনও গোপন কথা প্রকাশ করেননি। কোনও প্রলোভনেও আতাহুয়ালপার প্রতি বিশ্বাসঘাতকতায় সম্মত করা যায়নি তাঁকে।