সময় অল্প, তবু গানাদো কয়াকে যা একটু জানিয়েছেন তা এই—তাভতি্যুইয়ুর এই চরম দুর্ভাগ্যের দিন রাজপুরোহিত ভিলিয়াক ভূমু তাঁর নিজের কাজে লাগাবার জন্যে কোনও গভীর শয়তানির খেলা খেলছেন বলে গানাদোর দৃঢ় বিশ্বাস হয়েছে। কামালকায় আতাহুয়ালপা আর সৌসায় হুয়াসকার বন্দি থাকায় নিজের চাল তিনি নির্বিঘ্নে সাজাতে পেরেছেন। এ দুজনকেই ডিঙিয়ে বিদেশি শত্রুর সাহায্যে পেরুতে সর্বেসর্বা হওয়াই তার স্বপ্ন। রাজপুরোহিত তো আছেনই, তার ওপর ইংকা নরেশই বা নয় কেন? ইংকা রাজরক্ত তাঁর শরীরেও আছে। সেদিক দিয়ে কোনও বাধা নেই। অন্য বাধা দূর করবার ব্যবস্থাও সুকৌশলে তিনি অনেক আগেই শুরু করেছেন। হুয়াসকার নিজের মুক্তি কেনবার জন্যে আতাহুয়ালপার চেয়েও বেশি সোনা ঘুষ দেবার প্রস্তাব বিদেশিদের সেনাপতির কাছে গোপনে পাঠান। এ প্রস্তাবের খবর কিন্তু আতাহুয়ালপারও অগোচর থাকে না। হুয়াসকার সৌসায় বন্দি হয়েও কেমন করে তাঁর এ প্রস্তাব পাঠাবার সুযোগ পেলেন, আর সে গোপন প্রস্তাবের খবর আবার সঙ্গে সঙ্গে আতাহুয়ালপার কাছেও কেমন করে পৌঁছোল ভাবতে গিয়ে তখনই গানাদো একটু সন্দিগ্ধ হয়েছিলেন। সে সন্দেহ ভুল নয় বলে এখন জেনেছেন। রাজপুরোহিত নিজেই এক ঢিলে দু-পাখি মারার এ ব্যবস্থা করেছিলেন। এ ব্যবস্থায় যা আশা করেছিলেন তার উলটো ফল দেখে ভিলিয়াক ভমু বেশ অস্থির হয়েছেন। দুই-ভাই-এর পরস্পরের ওপর আক্রোশ হিংসা চরমে ওঠবার বদলে আতাহুয়ালপার কাছ থেকে এরকম মিলনের প্রস্তাব আসবে রাজপুরোহিত ভাবতে পারেননি। তাঁর অনেক পাকা খুঁটি তাতে কেঁচে গিয়েছে। নতুন করে তাঁকে আবার চাল ভাবতে আর সাজাতে হবে। আতাহুয়ালপার প্রস্তাব হুয়াসকার-এর কাছে পৌঁছোতে দিতে তিনি চান না। সেই জন্যেই প্রস্তুত হবার ছুতো করে সময় নিয়েছেন। কিন্তু সময় এক মুহূর্ত আর নষ্ট করা চলবে না। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব হুয়াসকার-এর হাতে আতাহুয়ালপার কিপু পৌঁছে দিতেই হবে। গানাদোর নিজের পক্ষে সৌসা যাওয়া আর সম্ভব নয়। গেলে ধরা পড়তে হবে। রাজপুরোহিত তাঁর ওপর কড়া নজর রাখবার ব্যবস্থা ইতিমধ্যেই নিশ্চয় করেছেন। যতুদূর বোঝা যাচ্ছে, তাঁকে বন্দি করবার মতলবই তাঁর আছে। অতিথিশালায় এখনই রাজপুরোহিতের অনুচরেরা হয়তো মোতায়েন হয়ে আছে সে উদ্দেশ্যে। গানাদোকে বাদ দিয়ে কয়াকে একাই তাই সৌসা যাবার দুঃসাধ্য ভার নিতে হবে। কেমন করে কয়া সেখানে যাবে, রাজপুরোহিতের অনুচরদের পাহারা ও দৃষ্টি এড়িয়ে কীভাবে হুয়াসকার-এর সঙ্গে গোপন সাক্ষাতে সুযোগ করে নেবে সে বিষয়ে কোনও পরামর্শ গানাদো দিতে পারবেন না! যা কিছু উপায় নিজেকেই ভেবে বার করতে হবে কয়াকে। চরম লাঞ্ছনার দিনের আগে কন্যাশ্রমের বাইরে কখনও যে পা দেয়নি তার ওপর এ দাবি যে নিষ্ঠুর অযৌক্তিক তা গানাদো। জানেন, কিন্তু এ ছাড়া আর কোনও পথ এখন নেই। রাজপুরোহিতের কুটিল চক্রান্তে এ পরিকল্পনা যদি ব্যর্থ হয়, হুয়াসকার আর আতাহুয়ালপাকে মিলিত করবার এই পরম সুযোগ যদি তারা না নিতে পারে, তা হলে পেরুর উদ্ধারের আশা আর বুঝি নেই। অসম্ভব জেনেও কয়াকে তাই গানাদো এ কাজে পাঠাচ্ছেন। মৃত্যু, আর তার চেয়েও বড় দুর্ভাগ্য এ দুঃসাহসের পুরস্কার হতে পারে জেনেই যেন কয়া এ ভার নেয়।
শেষ কথাগুলো বলতে বলতে গানাদোর কণ্ঠস্বর কি একটু রুদ্ধ হয়ে এসেছে। আপনা থেকে?
মুখের ভাবে কিন্তু কোনও আবেগই তিনি ফুটতে দেননি।
প্রায় কঠিন মুখে সমস্ত বক্তব্য শেষ করে নিজের আলখাল্লা গোছের পোশাকের ভেতর থেকে ভিকুনার পশমি কাপড়ে বোনা একটি ছোট থলি তিনি কয়ার হাতে দিয়ে বলেছেন, হুয়াসকার-এর কাছে যদি পৌছোত পারো কোনওরকমে, তা হলে শুধু আতাহুয়ালপার কিপু দেখে তিনি তোমায় বিশ্বাস না-ও করতে পারেন। আতাহুয়ালপার নিজস্ব গ্রন্থি-চিহ্ন হুয়াসকার জানেন না, জানবার কথা নয়। তুমি যে যথার্থই আতাহুয়ালপার দূতী, আর আতাহুয়ালপার কোনও কপট উদ্দেশ্য যে নেই, তার প্রমাণ এই থলির মধ্যেই রইল। এই তোমার সত্যকার অভিজ্ঞান। এ অভিজ্ঞান দেখলে তোমাকে বা আতাহুয়ালপাকে আর অবিশ্বাস করা যে হুয়াসকার-এর পক্ষে সম্ভব নয় এইটুকু নিশ্চিত বলে জেনো। এ অভিজ্ঞান যেন না হারায়।
যা বলবার সবই বলা হয়েছে। এইবার পরস্পরের কাছে বিদায় নিলেই হয়। তবু গানাদো কয়েক মুহূর্ত যেন স্থাণুর মতো দাঁড়িয়ে থেকেছেন। কয়াও নিস্পন্দ নীরব।
হঠাৎ ভেতরের কী যেন এক অস্থিরতায় গানাদো একেবারে যেন অন্য মানুষ হয়ে গেছেন। কয়ার হাত থেকে থলিটা প্রায় ঝটকা দিয়ে ছিনিয়ে নিয়ে উত্তেজিত গলায় বলেছেন, না কয়া, কোথাও তোমাকে যেতে হবে না। আতাহুয়ালপা আর হুয়াসকার-এর ভাগ্যে যা থাকে থাক, পেরুর পরিণাম যা হয় তোক, তা রোধ করবার এই বাতুল নিষ্ফল চেষ্টায় তোমাকে এমন করে আত্মবলি দিতে পাঠাবার কোনও অধিকার আমার নেই। তুমি যেখানে আছে সেইখানেই থাকো কয়া। দরকার বোধ করলে রাজপুরোহিতের আশ্রয়ও তুমি চাইতে পারো। তুমি সব চক্রান্তের বাইরে, নির্দোষ নিরাপরাধ আমারই হাতের পুতুল মাত্র বুঝে তিনি নিশ্চয়ই তোমায় কোনও শাস্তি দেবেন না। আমি এবার চলি। তোমার দেখা পাওয়ার পর স্বপ্নের মতো যে ক-টা দিন আমার কেটেছে তার জন্যেই ভাগ্যের কাছে আমি চিরকৃতজ্ঞ থাকব।