গানাদো খানিক চুপ করে থেকেছেন। তারপর ঈষৎ গম্ভীর স্বরেই বলেছেন, যদি বলি পাপের প্রায়শ্চিত্ত।
রাজপুরোহিতের ভ্রু কুঞ্চিত হয়ে উঠতে দেখে একটু হেসে তৎক্ষণাৎ আবার বলেছেন, না, না, সত্যিকার স্বার্থ যে কী তা তো বুঝতেই পারছেন। নিজের দলের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতার দাম হিসেবে আপনাদের কাছে বড়গোছের ইনাম চাই। ধরুন দেশে নিয়ে যাবার মতো এক জাহাজ সোনা।
না।তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে গানাদোর দিকে চেয়ে রাজপুরোহিত মাথা নেড়ে বলেছেন, তা হতে পারে না। এ বিশ্বাসঘাতকতার পর সোনার জাহাজ নিয়ে ফেরবার দেশ আর আপনার থাকবে না। এইখানেই আপনাকে জীবন কাটাতে হবে।
তাই না হয় কাটাব। প্রসন্ন মুখে বলেছেন গানাদো, থাকবার পক্ষে এ তো সত্যি সোনার দেশ! শুধু এর অভিশাপটা না দূর করলে নয়। তারই জন্যে হুয়াসকার-এর কাছে এখুনি যাওয়া দরকার। আমাদের জন্যে সেই ব্যবস্থাই করুন, এই অনুরোধ। কাল সকালেই যেন আমরা রওনা হতে পারি।
কাল সকালেই? বেশ একটু চিন্তিত দেখা গেছে রাজপুরোহিতকে। নিজের মনে কী যেন তোলাপাড়া করে নিয়ে কয়েক মুহূর্ত বাদে দুঃখের সঙ্গে মাথা নেড়ে বলেছেন,
না, কাল সকালে আপনাদের পাঠানো সম্ভব নয়। প্রস্তুত হবার জন্যে সময় দিতে হবে আর একটু।
প্রস্তুত আবার কীসের জন্যে হবেন! গানাদো একটু অবাক হয়ে বলেছেন, এ তো আপনারই এলাকা। আমাদের সৌসা যাবার অনুমতিটা শুধু দিলেই হবে।
না, শুধু তাই দিলেই হবে না। গম্ভীরভাবে বলেছেন রাজপুরোহিত, আমার অনুমতি নিয়ে আপনারা সৌসা গিয়ে পৌঁছোতে পারেন। সেখানে হুয়াসকার ওই মুইস্কা মেয়েটিকে আতাহুয়ালপার দূতী বলি বিশ্বাস করবেন ধরে নিচ্ছি, ধরে নিচ্ছি। যে আতাহুয়ালপার প্রস্তাবে তিনি রাজি হবেন, কিন্তু তাতেই তাঁর বন্দিত্বের শিকল তো আপনা থেকে খসে পড়বে না! সৌসা দুর্গকারার দরজাও খুলে যাবে না ভোজবাজিতে।
রাজপুরোহিত যুক্তি যা দেখিয়েছেন তা অগ্রাহ্য করবার নয়। তবু গানাদো একটু মৃদু প্রতিবাদ না করে পারেননি। বলেছেন একটু হেসে, আপনার আদেশই তো সেই ভোজবাজি। আমাদের সৌসা যাবার অনুমতি যেমন দিচ্ছেন, সেই সঙ্গে আমাদের সায় পেলে হুয়াসকারকে যাতে মুক্তি দেওয়া হয়, সে হুকুমও পাঠিয়ে দিন।
ব্যাপারটা কি এত সোজা! এবার একটু অধৈর্যই প্রকাশ পেয়েছে রাজপুরোহিতের কণ্ঠস্বরে—ফাঁস দেবার দড়ি গলায় পরিয়ে একলহমায় তাকে ফুলের মালা বানানো যায় না। হুয়াসকারকে পরম শত্রু হিসেবে আগলানো যাদের ধর্মকাজ বলে বুঝিয়েছি তারা হঠাৎ আমার উলটো হুকুমে বেঁকে দাঁড়াবে না তার ঠিক কী! খেলার খুঁটি ঘুরিয়ে সাজাবার তাই সময় চাই একটু। বেশি নয়, ধৈর্য ধরে দু-চারটে দিন কোরিকাঞ্চার অতিথি হয়ে আয়েশ করুন। সব ব্যবস্থা পাকা করে তারপরই আপনাদের সৌসা পাঠাচ্ছি।
দু-চারদিন অপেক্ষা করা মানে যে কী বিপদের ঝক্কি নেওয়া তা বুঝিয়ে গানাদো এ ব্যবস্থার প্রতিবাদ করতে পারতেন। কিন্তু তা তিনি করেননি। বরং রাজপুরোহিতের যুক্তি যেন অকাট্য বলেই মেনে নিয়ে খুশি মুখে বিদায় নিয়ে গেছেন।
সূর্যবেদিকার কক্ষ থেকে নিজেদের আস্তানায় কিন্তু তিনি ফিরে যাননি। দূরদূরান্তরের পূজারিণীদের জন্যে কোরিকাঞ্চায় যে কয়েকটি পৃথক অতিথিশালা আছে তারই একটিতে গিয়ে কয়া-র সঙ্গে প্রথমে দেখা করেছেন। সোনারদারের ছদ্মবেশ ছাড়বার পর থেকে কয়া দূর অঞ্চলের তীর্থযাত্রিণী হিসেবে অতিথিশালাতে আশ্রয় নিয়েছে।
কয়ার সঙ্গে দেখা হওয়ার পর গানাদো প্রথমে রাজপুরোহিতের সঙ্গে তাঁর যা আলাপ হয়েছে তার বিবরণ দিতে দিতে হঠাৎ অপ্রত্যাশিতভাবে জিজ্ঞাসা করেছেন, এই তাভানতিনসুইয়ুকে আবার পবিত্র করে তুলতে চাও, কয়া?
এ প্রশ্ন কেন? গানাদোর দিকে বিমূঢ় ব্যাকুল দৃষ্টি তুলে জিজ্ঞাসা করেছে কয়া। কারণ তা করতে চাইলে চরম আত্মবলির জন্যে এবার তোমায় প্রস্তুত থাকতে হবে। বলেছেন গানাদো, সে সংকল্পের সাহস আছে কি না তাই জানতে চাই।
সাহস আছে। সরল স্নিগ্ধ স্বরে বলেছে কয়া, কিন্তু নিজের মনকে তো কেউ সত্যি চেনে না। যথার্থ পরীক্ষার দিনে এ সাহস কতখানি থাকবে এখন কী করে বলব! তবু কী আমায় করতে হবে, বলো। যারা আমাদের এই পবিত্র দেশকে ধর্ষণ করেছে তাদের পাপস্পর্শ দূর করবার জন্যে যা তুমি বলবে তাই করতে আমি প্রস্তুত।
তা হলে শোনো কয়া, বিষণ্ণ গম্ভীর স্বরে বলেছেন গানাদো, তোমাকে প্রায় অসাধ্য কাজেই পাঠাচ্ছি। সৌসায় হুয়াসকার-এর কাছে একাই তোমায় যেতে হবে। যেতে হবে একা শুধু নয়, রাজপুরোহিতের অনুমতি ছাড়া এবং আজ, এখনই।
প্রতিবাদ করেনি কয়া, কোনও প্রশ্ন তোলেনি এ আদেশ নিয়ে। গানাদোর মুখের দিকে পরম নির্ভরতার দৃষ্টিতে চেয়ে শুধু বলেছে, তা-ই যাচ্ছি। তুমি কি এখানেই থাকবে?
না, বোধহয়। একটু তিক্ত হাসি ফুটে উঠেছে গানাদোর মুখে—যতদূর বুঝতে পেরেছি আমাকে আরও নিরাপদ জায়গায় রাখবার আয়োজনই করছেন তোমাদের রাজপুরোহিত।
পরিহাসের সুরে বলা কথা। কিন্তু তারই মধ্যে কী যেন একটা অনুভব করে শংকিত কাতরতা ফুটে উঠেছে কয়ার দু-চোখে। ব্যাকুলভাবে বলেছে, কী তুমি বলতে চাইছ আমি বুঝতে পারছি না।
বোঝবার মতো করেই তা হলে বলি, গম্ভীর হয়ে উঠেছে এবার গানাদোর মুখ আর গলার স্বর—অত বড় শক্তির বিরুদ্ধে আমাদের বুঝতে হবে তা তোমার জেনে রাখাই উচিত।