কিন্তু তা তিনি করেননি। করা সম্ভব নয়। ইংকা নরেশের নিজস্ব গোপন এমন কিছু গ্রন্থিবৈশিষ্ট্য এ কিপুতে আছে যার রহস্য একমাত্র ইংকা নরেশ স্বয়ং, পেরুর রাজপুরোহিত আর প্রধান সেনাপতিই জানেন। অন্য কারও পক্ষে তা নকল করা অসম্ভব।
এ কিপু সুতরাং অবিশ্বাস করা যায় না। কিন্তু তাতে যে আদেশ দেওয়া হয়েছে তা সত্যিই বিশ্বাসের বাইরে। আতাহুয়ালপার কিপুতে এবার সোনা পাঠাবার নির্দেশ নেই।
দূতী হিসেবে মুইস্কা বংশের মেয়েটির পরিচয় দিয়ে এমন একটি কাজে তাকে যথাসাধ্য সাহায্য করার আদেশ আছে যা সর্বনাশা বাতুলতা বলেই মনে হয়েছে। রাজুপুরোহিতের।
আতাহুয়ালপা জানিয়েছেন যে, তাঁর দূতী মুইস্কা কুমারী সৌসা দুর্গে বন্দি হুয়াসকার-এর কাছে একটি বিশেষ প্রস্তাব নিয়ে যাচ্ছে। যত দ্রুত সম্ভব তাকে সৌসা দুর্গে পৌঁছে দেবার ব্যবস্থা ভিলিয়াক ভমুকে করতে হবে। আর আতাহুয়ালপার প্রস্তাবে রাজি হলে মুক্ত করতে হবে হুয়াসকারকে।
মুক্ত করতে হবে হুয়াসকারকে!
কিপুর রঙিন গ্রন্থিগুলোর ভুল অর্থ করেছেন কি না একবার এমন সন্দেহ হয়েছে। রাজপুরোহিতের।
হুয়াসকারকে মুক্ত করা মানে তো জেনে শুনে গলায় দোকর মরণফাঁস টানা। আতাহুয়ালপার গলায় সাদা বিদেশি শয়তানের ফাঁস তো লাগানোই আছে, তার ওপর হুয়াসকারকে ছেড়ে দিলে সর্বনাশের কি বাকি থাকবে কিছু?
আতাহুয়ালপার প্রস্তাবে রাজি হলে তবে হুয়াসকারকে ছাড়বার কথা আছে। অবশ্য।
কিন্তু সত্যের তেজ ছাড়া মিথ্যের এক রত্তি কালো ছায়া যাঁর দেহে নেই হুয়াসকার। কি সেই সূর্যদেব? ছাড়া পাবার জন্যে আতাহুয়ালপার প্রস্তাবে রাজি হবার ভান করতে তার আটকাচ্ছে কোথায়? একবার ছাড়া পেলেই সে যে নিজমূর্তি ধরবে, এ-বিষয়ে কোনও সন্দেহই নেই। কী বিশ্বাসে হুয়াসকারকে এরকম সুযোগ তা হলে দেওয়া হচ্ছে?
এরকম অনেক প্রশ্নেই রাজপুরোহিতের মন অস্থির হয়ে উঠেছিল। এতসব উদ্বেগ দুর্ভাবনা কি সত্যিই ইংকা নরেশের বিপদের কথা ভেবে? তা যদি হয় তা হলে আতাহুয়ালপা নিজেই যে এসব প্রশ্ন একদিন তুলেছিলেন এইটুকু জানলে রাজপুরোহিত বিস্মিত হতেন নিশ্চয়।
গানাদোর আর সব পরামর্শ মেনে নিলেও প্রথমে আতাহুয়ালপা হুয়াসকারকে মুক্তি দেওয়ার সম্পূর্ণ বিপক্ষে ছিলেন সত্যিই। বিদেশি শত্রুর বিরুদ্ধে মরণপণ করে আতাহুয়ালপার পাশে দাঁড়িয়ে লড়বে, এমন কথা দিলে হুয়াসকারকে মুক্তি দেওয়া হবে।
কিন্তু তার কথার দাম কী? গভীর সন্দেহের সঙ্গে জিজ্ঞাসা করেছিলেন আতাহুয়ালপা। বলেছিলেন, মুক্তি পাবার জন্যে সে তো অম্লান বদনে কথা দেবে মিথ্যে করে।
হ্যাঁ, মিথ্যে করেই কথা দিতে পারেন, বলেছিলেন গানাদো, কিন্তু মুক্তি পাবার পর তিনি কথা রাখবেন সত্যি করে।
কেন? বিস্ময় প্রকাশ করেছিলেন আতাহুয়ালপা।
কারণ আপনার বিরুদ্ধে যত আক্রোশই থাক, সাচ্চা ইংকা হলে, মুক্তি পাবার পর আরও ভাল করে তিনি বুঝবেন যে সৌসা দুর্গ থেকে ছাড়া পাওয়াটা কিছুই নয়, বিদেশি শত্রুকে না তাড়ানো পর্যন্ত সমস্ত পেরুই সৌসা দুর্গের চেয়ে অসহ্য বন্দিশালা। আর বিদেশি শত্রুকে তাড়াতে হলে আপনার পাশে না দাঁড়ালেও নয়।
আতাহুয়ালপা এর পর আর কোনও প্রশ্ন তোলেননি।
রাজপুরোহিতের মনে অসংখ্য প্রশ্নের খোঁচা কিন্তু থেকেই গেছে। সে সমস্ত এই মেয়েটির কাছে তোলবার নয়। তাকে শুধু একটি প্রশ্নই তিনি করেছেন, সৌসায় হুয়াসকার-এর কাছে তোমায় পাঠাবার ব্যবস্থা করছি। কিন্তু তুমি যে সত্যিই আতাহুয়ালপার দূতী তা তিনি বিশ্বাস করবেন কেন? এটা যে তাঁকে ফাঁদে ফেলবার একটা ষড়যন্ত্র নয় তা তিনি বুঝবেন কীসে?
যাতে বোঝেন সেই ব্যবস্থাই করেছেন গানাদো। গভীর বিশ্বাসের সঙ্গে বলেছে। কয়া।
গানাদো! তিনি আবার কে?সবিস্ময়ে জিজ্ঞাসা করেছেন রাজপুরোহিত।
তিনি উদয়-সমুদ্র-তীরের এক আশ্চর্য মানুষ! কয়ার কণ্ঠস্বর গাঢ় হয়ে উঠেছে। মুগ্ধতায় তাভানতিনসুইয়ুকে উদ্ধার করবার সমস্ত পরিকল্পনার মূলে তিনিই আছেন।
রাজপুরোহিতের চোখে হঠাৎ কী যেন একটা ঝিলিক দেখা গেছে। কৌতূহল আর সম্রম মেশানো গলাতেই যেন জিজ্ঞাসা করেছেন, এ মহাপুরুষের দেখা পাওয়া কি সম্ভব?
২২. প্রচ্ছন্ন বিদ্রূপের সঙ্গে
প্রচ্ছন্ন বিদ্রূপের সঙ্গে কি না বলা যায় না, মহাপুরুষ যাঁকে বলেছিলেন, তাঁর সঙ্গে রাজপুরোহিত ভিলিয়াক ভমুর দেখা হয়েছিল সেইদিনই।
গানাদোর সামান্য পরিচয় কয়ার কাছে পাবার পর কেন যে রাজপুরোহিতের চোখে একটা ঝিলিক দেখা গিয়েছিল তা একটু যেন বোঝা গিয়েছিল এবার।
ভিলিয়াক ভমু আতাহুয়ালপারই দলের লোক। ইংকা নরেশের অধীন হলেও তাভানতিনসুইয়ুর ধর্মজগতের প্রধান হিসেবে ক্ষমতা তাঁর অশেষ। বিদেশি শত্রুর বিরুদ্ধে দেশব্যাপী অভ্যুত্থানে তাঁর ভূমিকাটা কারও চেয়ে ছোট হবে না।
গানাদো তাই হুয়াসকারকে মুক্তি দেবার প্রয়োজন বোঝাতে তাঁর পরিকল্পনাটা রাজপুরোহিতকে একটু বিশদভাবেই জানিয়েছিলেন।
শুনতে শুনতে স্পষ্টই উত্তেজিত হতে দেখা গিয়েছিল রাজপুরোহিতকে! খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে অনেক কথাই তিনি জানতে চেয়েছিলেন গানাদোর কাছে। তারই মধ্যে হঠাৎ জিজ্ঞাসা করেছিলেন, যে বিদেশি শয়তানদের বিরুদ্ধে পেরুবাসীদের জাগাতে চাচ্ছেন, আপনি নিজেও তাদেরই একজন। এ দেশকে উদ্ধার করায় আপনার কী স্বার্থ?