কিন্তু তারপর সামনে এ কী দেখলাম? কোথায় সেই ধু ধু করা লাল কাঁকুরে ডাঙা! এ তো যেন বাঁধানো সমুদ্র তীরের খানিকটা। সমুদ্রের রঙ হলুদ মেশানো সবুজ, আর সমুদ্রের ধারে অসংখ্য গুহার মতো ফাঁকওয়ালা বিশাল এক চ্যাপ্টা নিচু দালান যার বিরাট ছাদটা মাপে একটা ছোটখাটো পার্কের মতো। আমাদের পৃথিবীর বড় বড় প্রাসাদের বাইরে কোনও বিশাল ছড়ানো বাগান থাকে—বিশাল ছড়ানো ছাদটা যেন তাই। কিন্তু সে পার্কের মতো ছাদে ওরা কারা? হ্যাঁ, নীচের অগুনতি গুহা-মুখ থেকে উঠেই তো সমুদ্রের জলে সাঁতরে বেরিয়ে আসতে আর সেখান থেকে গুহা-মুখে ঢুকতে দেখা যাচ্ছে ওদের। কিন্তু ওরা কী রকম প্রাণী? চেহারাটা কতকটা ঘেরাটোপে অক্টোপাসের মতো নয় কি? হ্যাঁ, অক্টোপাসই। তবে ঘেরাটোপের ওপরে চকচকে চোখ বসানো প্রকাণ্ড মাথাটার চারিধারে চারটে বাহুঁ, আর বাকি চারটে খাটো ঘাঘরার মত ঘেরাটোপের নীচে। সেগুলোয় ভর দিয়ে তাদের চলাফেরাই শুধু অদ্ভুত নয়, অদ্ভুত তাদের আরও অনেক কিছু। প্রথমত তাদের গায়ের রঙ। পার্কের মতো বিরাট চ্যাপ্টা প্রাসাদের ছাদে কিছু একটা জটলার ব্যাপার আছে বলে মনে হয়! অসংখ্য ঘেরাটোপ জড়ানো অক্টোপাস সেখানে জড়ো হয়েছে দেখা যাচ্ছে। নীচের সমুদ্র থেকে গুহা-মুখ দিয়ে দলে দলে যেমন আসছে ওপরের আকাশ থেকেও তেমনই বড় বড় বাদুড়ের মতো প্রাণীর পিঠে সওয়ার হয়ে আসছে আরও অনেকে। শুধু বাদুড়ের পিঠে চড়ে আসাটাই আশ্চর্য নয়। আশ্চর্য তাদের গায়ের রঙও। নীচের ছাদে যারা জড়ো হয়েছে তাদের মধ্যে চারটে নীল হলদে থাকলেও অধিকাংশই সবুজ রঙ-এর। কিন্তু হাঁসে চড়ে যারা আসছে ওরা সবাই ফিকে লাল। মনে হচ্ছে একটা খুব বড় গগাছের সমাবেশ এখানে হচ্ছে। কিন্তু কাদের সমাবেশ? কারা এরা? স্বপ্ন যদি না হয় তাহলে এ কী দেখছি।
হঠাৎ কপালে কী একটা ঠাণ্ডা ছোঁয়ায় চমকে উঠে দেখলাম ঘেরাটোপ জড়ানো এক অক্টোপাস মূর্তি আমার পাশে দাঁড়িয়ে আমার মাথার ওপর থেকে কপালের দুধারের রগে কী একটা এঁটে দিয়েছে।
প্রথমে একটু মাথা ঝিম ঝিম। তারপরই স্পষ্ট শুনতে পেলাম, ভয় পেয়ে নাযা তোমার মাথায় পরিয়ে দিয়েছি তাতে, তোমার নিজের ভাষা যা-ই হোক, আমাদের সব কথা তুমি নিজের ভাষাতেই স্পষ্ট বুঝতে পারবে। এ কোনও অণুবশ যন্ত্রট নয়। যে যেখানকারই হোক, তোমার মতো বুদ্ধিমান প্রাণীর মস্তিষ্কের যে-অংশের বিশেষ ক্ষমতায় পরস্পরের সঙ্গে যোগাযোগের কৃত্রিম ভাষা মূল যথার্থ অর্থে অনুবাদ হয়ে যায়, আমাদের দুজনের মস্তিষ্কের সেই অংশই এ-যন্ত্রে জুড়ে দেওয়া হয়েছে। এই জুড়ে দেওয়ার দরুন তোমার কথা আমি, আর আমার কথা তুমি ঠিক যেন নিজেদের ভাষায় বলা কথার মতোই বুঝতে পারছ। এখন তোমার মনে যে প্রশ্ন একটা উঠেছে তার উত্তর আগে দিচ্ছি, শোনো। তুমি যা দেখছ তা সত্যই এই জগতের এক মহাসমাজ। এ জগতের সব প্রান্তবাসী আমাদের সব জাতি উপজাতির প্রতিনিধি এখানে এ-জগতের ভবিষ্যৎ নিয়ে এক চরম সিদ্ধান্ত নিতে চায়। আমাদের হাতে সময় বেশি নেই। তোমার মনের অন্য ক-টি প্রশ্নের উত্তর সংক্ষেপে আগে দিয়ে নিচ্ছি। হ্যাঁ, তুমি যা ভেবেছ তাই। তোমাদের জগতের ফাইলাম মোলাস্ক-এর অক্টোপাসের মতো প্রাণীই এখানে সভ্যতার সবচেয়ে উঁচু ধাপে পৌঁছেছে। তোমাদের পৃথিবীতেও এই ফাইলাম মোলাস্ক-এর অক্টোপাস-এর মতো প্রাণীর মধ্যেও অনেক সম্ভাবনা যে আছে। তাদের শরীরের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ এবং প্রকাণ্ড মাথায় বুদ্ধিটুদ্ধির পরিচয় থেকেই তার প্রমাণ পাওয়া যায়। সময় নেই তাই সে কথা এখন থাক। আমাদের এই মহাসমাবেশ কী জন্য তাই বলি। তোমাদের দেশের বাদুড়ের মতো প্রাণীর পিঠে চড়ে আমাদের একদল প্রতিনিধিকে আসতে দেখে তুমি অবাক হয়েছ। ভাবছ বাহন হিসেবে বেগবান যন্ত্র উদ্ভাবন করতে পারিনি বলেই আমরা আদিমকালের মতো অন্য প্রাণীই বাহন হিসাবে ব্যবহার করি। না, তা নয়। আমরা যন্ত্রবিদ্যায় প্রায় শেষ সীমায় পৌঁছে, যে বিজ্ঞান পরমাণু-বোমা দিয়ে সৃষ্টি ধ্বংস করতে চায়, তা রোধ করার প্রতিজ্ঞা নিয়েছি। আজকের মহাসমাবেশও তাই নিয়ে। সময় নেই, নইলে আমাদের সব জাদুঘরে পারমাণবিক যুগের সমস্ত আশ্চর্য যন্ত্র তোমায় দেখাতাম। সেগুলো বাতিল করে এখন জাদুঘরে রাখা হয়েছে। আমাদের একদল এখন আর-সব যন্ত্র, এমন কী এই আমার ঘেরাটোপের মতো বস্ত্র বোনবার যন্ত্রও, বাতিল করে একেবারে আদিম প্রাকৃতিক অবস্থায় ফিরে যেতে চায়। আর-এক দল কিন্তু যন্ত্রের ওপর রাশ টেনে প্রকৃতির সঙ্গে সুর মেলানো জীবনের সঙ্গে তার একটা সামঞ্জস্য করতে চায়। আমরা আরও পিছিয়ে একেবারে সেই আদিম অবস্থায় ফিরে যাব, না যন্ত্রকে সরল স্বাভাবিক জীবনের সঙ্গে বেঁধে আর এক সভ্যতা সৃষ্টি করব এই প্রশ্নের আজ মীমাংসা হবে। এদিকে সময় যে একেবারে ফুরিয়ে এসেছে সে খেয়াল আমার নেই! আমি
বাধা দিয়ে বললাম, বারবার তুমি সময় নেই সময় নেই বলছ কেন বলো তো! কীসের সময় নেই।
সময় নেই আমাদের আলাপের। মাথার ভেতর শুনলাম, যা তুমি দেখছ শুনছ এসব কোথা থেকে কী করে সম্ভব হল তুমি নিশ্চয় ভাবছ। শোনো, তুমি যা দেখছ তা এক আশ্চর্য অবিশ্বাস্য ব্যাপার। কালো ফুটোর জগতের মানুষ তুমি সাদা ফুটোর ভেতর দিয়ে আর-এক বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের ব্যাপার দেখতে পাচ্ছ। কালো ফুটোর কথা তুমি ভাল করে জানো। তোমাদের বিশ্বব্রহ্মাণ্ড তোমাদের মাঝে প্রতি সেকেন্ডে ১৮৬০০০ মাইল যে-আলোর গতি সেই আলো লক্ষ কোটি বছরে যা পার হতে পারে না, তোমাদের সেই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের বাইরে আরও বিশ্বব্রহ্মাণ্ড যে থাকতে পারে, তোমাদের বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের কালো ফুটো থেকেই তার কিছু আভাস তোমরা বোধহয় পেয়েছ। কালো ফুটো এমন এক প্রচণ্ড মাধ্যাকর্ষণের গর্ত যেখানে মাধ্যাকর্ষণের টানে কাছাকাছি গ্রহ তারা সব কিছু এমন তলিয়ে যায়