কিন্তু তা হল না। সবই হারাবার চেয়ে কিছু পাওয়াই যে ভাল বুঝে তিন দল এক হয়ে একটি প্রশ্ন নিয়েই ঘনাদার ইন্টারভিউ নিতে নীচে থেকে আমাদের আড্ডা ঘরে উঠে এল। এদিকে ওদিকে সুবিধা মতো বসে একটু তোতলামি নিয়েই তাদের প্রশ্নটা জানাল।
প্রশ্ন শুনে আমরা খুশিই হলাম বলতে পারি। যা ভয় করেছিলাম সেরকম সৃষ্টি ছাড়া কোনও প্রশ্ন নয়। তার বদলে নিতান্ত সরল সহজ একটা জিজ্ঞাসা। সেটা হল এই যে সারাজীবনে ঘনাদা তো দুনিয়ার অনেক জায়গায় ঘুরেছেন, তার মধ্যে সবচেয়ে আশ্চর্য করেছে তাঁকে কোন জায়গা? সব চেয়ে আশ্চর্য করেছে কোন জায়গা?
ঘনাদা যেভাবে প্রশ্নটা নিজের মুখে আবার উচ্চারণ করে শোনালেন মনে হল উত্তরটা দিতে তাঁকে বেশ ভাবতে হবে।
কিন্তু না। প্রশ্নটা নিজে আউড়ে নিয়ে তৎক্ষণাৎ উত্তরটা তিনি শুনিয়ে দিলেন—ঘুঘুডাঙা।
ঘুঘুডাঙ্গা!
ইন্টারভিউ নিতে আসা দল চুপ তো বটেই, আমরাও একেবারে হাঁ।
আমাদের অবস্থাটা ঠিক মতো অনুমান করে ঘনাদা এবার ব্যাখ্যা করে বললেন, শুধু ঘুঘুডাঙা শুনে অবশ্য বুঝতে কিছু পারবে না। জায়গাটা তেমন দূর কোথাও না হলেও নামকরা কোনও জায়গা নয়। সত্যি কথা বলতে গেলে ঘুঘুডাঙা নামটাই খুব কম লোকের জানা আছে। হাওড়া থেকে লুপ লাইনে যেতে খানা জংশন ছাড়াবার কিছু পর বিরাট একটা ডাঙা পেরিয়ে যেতে হয়। ছোটখাটো ডাঙা তো নয়, মাঝে মাঝে দু-চারটে শাল পিয়ালের পাতলা জঙ্গল নিয়ে ডাঙাটা একনাগাড়ে অমন চল্লিশ-পঞ্চাশ মাইল ছড়ানো। নদী নালা নেই, শুধু এখানে সেখানে লাল কাঁকুরে মাটির ঢিবি নিয়ে জায়গাটার যেন আধা মরুভূমির মতো চেহারা।
এই নেহাত নিষ্ফলা সকল কাজের বার ডাঙা জমিটা আমার চেনা এক খেয়ালি ভদ্রলোক একেবারে জলের দরে শ-দেড়েক বিঘে কিনে সেখানে একটা বাংলো গোছের বাড়ি বানিয়ে ছিল। তার আশা ছিল এই নিষ্ফলা আধা-মরু ডাঙার অনেক নীচে কোথাও কোনও পাতাল-ধারার সন্ধান সে পাবে, আর কল্পনা ছিল যে তাই দিয়ে ওখানে এক নন্দনকানন বানিয়ে তুলবে। ডাঙা জমিটা কিনে বাংলো বাড়িটার অর্ধেক তুলতে তুলতেই খেয়ালি মানুষটা মরে যায়! তার যারা ওয়ারিশন তারা এখন ঘনাদার লোককে জলের দরেই ও সম্পত্তি বেচে দিতে রাজি থাকলেও বহুদিন কোনও খরিদ্দার তাদের জোটেনি। সে সময়টা, শুধু নির্জনতার খাতিরে আমি মাঝে মাঝে সেখানকার সেই আধা তৈরি বাংলো বাড়িটা ভাড়া নিয়ে সেখানে গিয়ে কিছু দিনের জন্য থাকতাম। ও ডাঙা জমি যে প্রথম কিনেছিল সেই খেয়ালি মানুষটি জায়গাটার নাম দিয়েছিল নন্দন। আমিই তা বদলে ঘুঘুডাঙা নাম রেখেছিলাম।
সেবার যখন ঘুঘুডাঙার বাংলোয় যাই তখন বর্ষাকাল শেষ হয়েছে। দেশে সেবার সব জায়গায় বৃষ্টি হয়েছে প্রচুর। শুধু ঘুঘুডাঙা একেবারে খটখটে শুকনো মরুভূমি। আকাশের মেঘগুলো যেন ওই অঞ্চলটা পার হবার সময় জল ঢালতে ভুলে যায়।
তবু শরতের গোড়ায় ওই ধু ধু লাল মাটির ডাঙারও কেমন একটা রূপ যেন খোলে। বিশেষ করে ভোরের আলোয় তার দিগন্ত ছোঁয়া শূন্যতারই একটা আলাদা আকর্ষণ আছে!
অনেক দূরের এক পুরো রেলস্টেশনও নয়, নম্বর দেওয়া হল্ট যাকে বলে, সেইরকম স্টেশনে বিকেলের আগে এক অখদ্যে প্যাসেঞ্জার ট্রেন থেকে নেমে জাদুঘরে রাখবার মতো গোরুর গাড়িতে কখনও মেঠো কাঁচা রাস্তা কখনও সটান উঁচুনিচু এবড়োখেবড়ো পাথুরে ডাঙার ওপর দিয়ে প্রায় দু প্রহর গাড়ি চালিয়ে রাত এগারোটা নাগাদ আমার ঘুঘুডাঙার বাংলো বাড়িতে এসে পৌঁছই। বহু দূরের এক গাঁ থেকে এক মুনিস-চাষি চৌকিদার হিসাবে মাঝে মাঝে এসে এ বাংলোটা দেখাশুনো করে যায়। আগে থাকতে চিঠিতে খবর দেওয়ায় সে এসে হয়তো ঘরদোরগুলো একটু সাফসুফ করে খাটিয়াটাটিয়া পেতে শোবার বিছানাটিছানা একটু ঝেড়ে ঝুড়ে দিয়ে চলে গেছে। রাতের খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থা করে আমার জন্য তার থাকার কথা নেই, সে থাকেনি। গোরুরগাড়ির গাড়োয়ানও আমায় পৌঁছে দিয়ে পরের দিন সকালে তার খেপ আছে বলে গাড়ি নিয়ে চলে গেল।
ওই ধু ধু ঘুঘুডাঙার আধভাঙা বাংলো বাড়িতে আমি একেবারে একা।
এই পর্যন্ত বলে ঘনাদা থেমে তাঁর সাক্ষাৎপ্রার্থীদের সঙ্গে আমাদের সকলের ওপর চোখ বুলিয়ে নিয়ে বললেন, কী ভাবছ সবাই? এরপর যা দেখব তা আশ্চর্য এক ভূতের কাণ্ডকারখানা? না। যা দেখেছি তা ভৌতিকের চেয়ে আরও আশ্চর্য ব্যাপার, কল্পনাও তার নাগাল পায় না এমন অবিশ্বাস্য রকম অদ্ভুত কিছু।
ঘনাদা আবার একটু থামলেন। আমরা প্রায় নিশ্বাস বন্ধ করে আছি। সারাদিনের ক্লান্তি। ঘনাদা বলতে শুরু করলেন, সঙ্গে আনা খাবারের সামান্য কিছু খেয়ে শুয়ে পড়ার পর কখন ঘুমিয়ে পড়েছিলাম জানি না। ঘুমটা ভোর হতেই বোধহয় ভাঙল। কিন্তু এ কী রকম ভোর! ভোরের আলো এমন সবুজ হল কী করে। হ্যাঁ, সবুজ। একটু বেশি করে হলদে মেশানো একরকম অদ্ভুত সবুজ! বিছানা ছেড়ে এক লাফে উঠে চারিদিকে চেয়ে একেবারে হতভম্ব। এ কোথায় আমি আছি! এখন কি স্বপ্ন দেখছি তাহলে? না, স্বপ্ন নয়। নিজেকে চিমটি কেটে, নাকে সুড়সুড়ি দিয়ে ঘেঁচে পরীক্ষা করে বুঝলাম, আমি পুরোপুরি জেগে আছি। কিন্তু কোথায়? আমার চারিধারে ঘরের দেওয়াল কি মাথার ওপর ছাদ নেই! কেমন যেন কাঁচের মতোই স্বচ্ছ একরকম ঢাকনা। আমি সামনে একটু এগিয়ে যেতেই সে ঢাকনা আপনা থেকেই যেন অদৃশ্য কবজায় উঠে গেল।