খানিক কেমন একটু হতভম্ব হয়ে চেয়ে থেকে প্রসঙ্গটা যেন ঠিক বুঝেছেন ভাব দেখিয়ে মুলতানি গোরুর দুধ সম্বন্ধে উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠেছেন।
এ সব পিত্তি-জ্বালানো চালাকির জবাব দেবার জন্যে আমাদের ওই আবোল। তাবোল প্যাঁচ।
যা খুশি একটা কিছু ধরে যত পারো আহাম্মকির গুল ঝেড়ে যাও। আরাম কেদারার তিনি যেন চিড়বিড়িয়ে উঠে আমাদের এক হাত না নিয়ে পারেন না।
কিন্তু একটানা আবোল তাবোল শুনে যাওয়াও তো চারটিখানি কথা নয়। যেটুকু গলাবাজি করেছি তাতেই তো আমাদের জিভ বেরিয়ে এসেছে।
শিশির তাই যেন কতকটা কাঁদো কাঁদো গলায় দিশাহারা অবস্থায় আরম্ভ করে—
তাহলে এখন উপায়?—ভাবছে সারা দুনিয়া। উপায় সত্যিই বুঝি নেই। কিন্তু তাহলেও হাল ছাড়া তো চলবে না।
বাঘা বাঘা সব মাতব্বর দেশ নয়, তাদের সামান্য একটা নখকুনির মতো পুঁচকে একটা ফুটকির মতো দ্বীপ, ব্রিটেন আর আয়ারল্যান্ডের মাঝখানের আইল অফ ম্যান-এর প্রেসিডেন্ট তাঁর লাইব্রেরি ঘরে বসে তাঁর আদরের বেড়ালটার মোটা ল্যাজে হাত বুলোতে বুলোতে হঠাৎ যেন জিভ কামড়ে চমকে লাফিয়ে উঠলেন!
ঠিক! ঠিক! এই কথাটা তো কারও মনে হয়নি।
বাঘা বাঘা দেশের বিশ্বজোড়া খোঁজাখুঁজির মধ্যে ওই তুচ্ছ ঠিকানাটাই ফাঁক পড়ে গেছে।
প্রেসিডেন্ট তখই ফোন করলেন তার সেক্রেটারিকে—শিগগির! শিগগির! এই ঠিকানায় এখুনি কেবল পাঠাও-বাহাত্তর নম্বর বনমালী নস্কর লেন—
মূর্খ!! ইডিয়ট!
অ্যাঃ—আমরা চমকিত। এ কার গলা? শিশিরের এই যা থাকে কপালে বলে ঝাঁপ দেওয়া প্যাঁচেই শেষ পর্যন্ত কাজ হল?
অসমাপ্ত
কালো ফুটো সাদা ফুটো
না, না, মাপ করবেন। দোহাই আপনাদের। আজ আর পেড়াপিড়ি করবেন না। আজ ওঁকে এই নিয়ে বিরক্ত করতে পারব না—
ছুটির দিন। একটু সকাল থেকেই আড্ডা ঘরে সবাই জমায়েত হয়েছি। টঙের ঘরের তিনিও নেমে এসে তাঁর মৌরসি কেদারাটা দখল করে বসেছেন।
এই সময়ে বারান্দা থেকে নীচের দিকে কাকে না কাদের উদ্দেশ করে গৌরের ওই চেঁচামেচি ভাল লাগে!
চেঁচামেচিটা কেন, কাকে উদ্দেশ করে তাও তো বোঝা যাচ্ছে না।
ওদিকে মৌরসি কেদারায় তাঁর মেজাজটাই না এই সাত সকালে বিগড়ে যায়।
প্রায় ধমকের সুরে গৌরকে তাই ডাকতে হল, এই, কী হচ্ছে কী? কার সঙ্গে কী জন্য অমন চেঁচামেচি করছিস?
আর কার সঙ্গে? গৌর বারান্দার রেলিং থেকে আমাদের দিকে ফিরে বিরক্ত গলায় বললে, সক্কাল বেলাই কী ঝামেলা দেখ দিকি!
এইটুকু বলেই আবার বারান্দার থেকে নীচের দিকে মুখ নামিয়ে একসঙ্গে বিরক্তি আর কাতরতা মিশিয়ে বললে, বললাম তো—আজ কিছু হওয়া সম্ভব নয়। আপনারা বরং আপনাদের নাম ঠিকানা রেখে গিয়ে পরের রবিবারে আসুন—হ্যাঁ, হ্যাঁ পরের—ওঁকে না আগে থেকে না জানিয়ে—–
ভেতর থেকে আবার আমাদের গলা ছেড়ে গৌরকে ডেকে ব্যাপারটা জানবার চেষ্টা করতে হল, শোন শোন, গৌর, শোন। ব্যাপারটা হয়েছে কী! এই সাত সকালে কার সঙ্গে চেচামেচি করছিস! কে ওরা? কী চায়?
কে ওরা? কী চায়? গৌর একেবারে গনগনে মেজাজে বললে, সব পত্রপত্রিকার প্রতিনিধি। এসেছেন দুর-দুরান্তর থেকে ঘনাদার ইন্টারভিউ মানে সাক্ষাৎকার নিতে। তাও কি কাছে পিঠের কোথাও থেকে? একজন এসেছে হলদিয়ার কাছের কোন গ্রাম থেকে, আর-একজন দুর্গাপুর থেকে, আর একজনরা বিহারের দানাপুর থেকে।
উৎসাহ খুব? আমাদের স্বীকার করতেই হল—তা কী নিয়ে ইন্টারভিউ মানে সাক্ষাৎকার তারা চায়?
কী নিয়ে আবার! গৌর আমাদের ওপরেই বিরক্ত হয়ে বললে, সাক্ষাৎকার কী নিয়ে হয় তা জানো না? এই আপনি কোথায় জন্মেছেন, পড়াশুনা কী করেছেন, আপনার বাড়িঘর কোথায়, কে আছে সেখানে কী খেতে ভালবাসেন!
এইসব নিয়ে বকিয়ে ঘনাদাকে জ্বালাতন করবে? আমরা ঘোর আপত্তি জানিয়ে বললাম, এ সাক্ষাৎকারে ওদের লাভ কী?
লাভ—যাঁর সাক্ষাৎকার নেওয়া হল তাঁকে নিয়ে বিনা খরচে অতি সহজে কাগজের খানিকটা পাতা ভরানো। গৌর তেতো গলায় বোঝালে, আজকাল এই এক নতুন কায়দা হয়েছে কাগজের কদর বাড়াবার। যাদের লেখা জোগাড় করা শক্ত তাদের সাক্ষাৎকার নাও। না দিয়ে পার পাওয়া সহজ নয়।
তা যে নয়, নীচের চেঁচামেচির মাত্রা চড়ে যাওয়া থেকেই তা তখন বোঝা যাচ্ছে। নীচে থেকে নানা পর্দার গলায় ডাক আসছে, ও মশাই শুনুন না, একবার শুনেই যান না।
কী করা যায় বলো তো, গৌর অসহায় ভাবে আমাদের দিকে তাকাল। ঠিক কী করা যায় ভেবে না পেয়ে আমরাও যখন সমান অসহায় তখন সমস্যাটা যাঁকে নিয়ে উপায়টা তিনিই বাতলালেন।
শোনো হে, শোনো! বলে ঘনাদা আমাদের জানালেন, ওই ইন্টারভিউ-এর জন্যে তিন দল এসেছে বলছ? বেশ ভাল কথা। ওই তিন দলকে একটা প্রস্তাব জানিয়ে বলো তা মানলে ওদেরই—ওরা একটা সাক্ষাৎকার পেতে পারে।
সাক্ষাৎকার পেতে পারে? ঘনাদা নিজেই কথা দিচ্ছেন? উৎসুক হয়ে জিজ্ঞাসা করলাম, কী প্রস্তাব, ঘনাদা?
প্রস্তাব এই যে, ঘনাদা ব্যাখ্যা করে শোনালেন, সাক্ষাৎকার আমি এক দলকেই দেব। আর শুধু একটা মাত্র প্রশ্নের বিষয়ে। এখন ওরা নিজেদের মধ্যে ঠিক করুক,
কোন দলের কোন প্রশ্ন নিয়ে ওরা সাক্ষাৎকার চায়। ওরা যদি নিজেদের মধ্যে সে বোঝাপড়া না করতে পারে তাহলে সব সাক্ষাৎকার বাতিল।
ঘনাদার প্রস্তাবটা ভালই ছিল। কিন্তু সেটা যে সত্যি কাজ দেবে তা ভাবিনি। ভেবেছিলাম, নিজেদের মধ্যে ঝগড়াঝাঁটি করেই তিন দল তাদের সুযোগটা নষ্ট করে করবে।