বাঘের আশঙ্কায় কেরী-পত্নী ভয় পেয়েছিল মাত্র, কিন্তু এ দৃশ্যে তার এমন জুগুপ্সা উপজাত হল যে, নাকে চোখে রুমাল চাপা দিয়ে গাড়ির পিঠদানিতে মুখ খুঁজল, কেবল মাঝে মাঝে বলতে লাগল—মাই গড! এ যে নরক, এ যে নরক!
সঙ্কীর্ণ কাঁচাপথ, তাতে অসমান। বর্ষার কাদা চক্রচিহ্নে শতধা-বিভক্ত হয়ে গিয়েছিল, এতদিনে তা শুকিয়েছে বটে, কিন্তু এখনও বন্ধুরতা লোপ পায় নি, তার উপরে ঘটেছে ধুলোর প্রাদুর্ভাব। রোদ বাড়বার সঙ্গে যানবাহনের চলাচল বাড়ল, উড়ল পাঁশুটে রঙের ধুলো। চিত্রবিচিত্র করা পালকি চলেছে বেহারাদের কিছুত সুরের তালে তালে; ফিটন, বুহাম, ল্যাভো, বগি, ব্রাউনবেরি চলেছে ঘোড়ার ক্ষুরে ক্ষুরে প্রচুর ধুলো উড়িয়ে; কখনও বা টাটুঘোড়ায় স্বল্পবেশ আরোহী, বাঁক কাঁধে চলেছে গাঁয়ের লোক, প্রকাণ্ড গোলপাতার ছাতা মাথায় পথিক, আর গাড়ি একটু থামবামাত্র এসে জোটে ভিক্ষুকের দল, ছেলে-বুড়ো, স্ত্রীলোক। কেরী ও কেরী-পত্নীর চোখে সবই নূতন। কেরী ভাবে, এই তো সত্যধর্ম প্রচারের উপযুক্ত স্থান; কেরী-পত্নী ভাবে, একগুঁয়ে স্বামীর হাতে পড়ে সভ্যজগতের বাইরে এসেছি, পাশেই সেই ভয়াবহ স্থান নরক!
ঐ সুন্দর বাড়িটা কার? শুধায় কেরী।
মিঃ লিসে নামে একজন ইংরেজের, আসাম থেকে হাতী আর কমলালেবু চালান দিয়ে বিস্তর টাকা করেছে লোকটা, বলে রামরাম বসু।
চৌরঙ্গী রোডের পুবদিক বরাবর বড় বড় হাতাওয়ালা বাড়ি, পশ্চিমদিকের মাঠে জলা-জঙ্গল আর নলখাগড়ার বন।
এ রাস্তাটা কোন দিকে গেল?
নেটিভ পল্লীর ভিতর দিয়ে শহরের পুবদিকে জলা পর্যন্ত গিয়েছে।
কি নাম রাস্তাটার?
জানবাজার রোড, ফেরবার সময় আমরা এই পথেই ফিরব।
প্রশ্নোত্তর চলে কেবী ও টমাসের মধ্যে।
গাড়ি আর একটু এগোতেই হঠাৎ টমাস বলে ওঠে, এই কোচম্যান, রোখো রোখো।
গাড়ি থামে।
টমাস বলে, ডাঃ কেরী, এই চৌমাথার ভূগোল তোমাকে বুঝিয়ে দিই, আশা করি চিত্তাকর্ষক হবে।
এই বলে টমাস শুরু করে-চৌরঙ্গী রোডের এখানে শেষ, এবারে ঐ শুরু হল কসাইটোলা স্ট্রীট। এ রাস্তাটাকে কলকাতার চীপসাইড বলা যেতে পারে। ইওরোপীয়, আর্মেনিয়ান, চীনা আর নেটিভদের যত-সব নামকরা বড় বড় দোকান কলকাতার চীপসাইড এই কসাইটোলাতে। খাট-চৌকি-পালঙ থেকে পোশাক-আশাক খাদ্যখানা সব মিলবে এখানে। মিসেস কেরী, তুমি যেন এ রাস্তাটার নাম ভুলো না। কলকাতায় ঘর করতে হলে Daintic Davie’-র দোকানে আসতেই হবে। আর কিছু নয়, শুধু একখানা ফর্দ রেখে গেলেই দু ঘণ্টার মধ্যে সব জিনিস তোমার কুঠিতে পৌঁছিয়ে দেবে।
মিসেস কেরী বিরক্তির সঙ্গে বলল, আমি চৌরঙ্গীর নরক পার হয়ে Daintie Davie কেন, স্বর্গেও যেতে রাজী নই।
তবে তোমার সরকারকে অর্থাৎ নেটিভ স্টুয়ার্ডকে হুকুম করলেই এনে দেবে। কিন্তু সত্য কথা কি জান, নিজে আনাই ভাল।
কেন?
ওরা টাকার উপর দু আনা দস্তুরি চাপিয়ে বিল করে।
তার মানে, চোর?
মিসেস কেরী, চোরের দাবী এত বেশি নয়, ওরা ডাকাত!
আর এদের উদ্ধার করবার জন্যেই এসেছে ডাঃ কেরী–বলে রুষ্ট মিসেস কেরী।
ডরোথি, ওদেরই তো আলোর বেশি প্রয়োজন।
তার আগে ওরা তোমার নিজের ঘর অন্ধকার করে ছাড়বে।
কি করে ডিয়ার?
তোমার তেল চুরি করে।
যখন কেরী, কেরী-পত্নী ও টমাসের মধ্যে এইসব কথাবার্তা হচ্ছিল, রামরাম বসু ও পার্বতী মনে মনে অস্বস্তি অনুভব করছিল, ভাবছিল ওরা আমাদের কোন দলের অন্তর্গত ভাবে, চোর না ডাকাত?
টমাস বলল, আর এই যে রাস্তাটা পুবদিকে গিয়েছে এটার নাম ধর্মতলা। এ রাস্তাটা গিয়েছে দেশী পাড়ায়, অবশ্য কিছু কিছু গরিব ফিরিঙ্গিও বাস করে এদিকে।
কেরী বলল হাঁ, পাড়াটাকে নিতান্ত দীন বলেই মনে হচ্ছে।
মাঝখান দিয়ে সরু কাঁচা রাস্তা, দুদিকে আম কাঁঠাল তেঁতুল বনের মধ্যে গোলপাতার কুঁড়েঘর, কোথাও বা আগাছায় ভরা জলা জমি, আবার কোথাও বা দু-চারখানি পাকা বাড়ি।
মিসেস কেরী বলে উঠল, ওদিকটায় আমি যেতে রাজী নই।
না না, ওদিকে যাব কেন, আমরা যাব পশ্চিমদিকে। এই কোচম্যান, চল এসপ্ল্যানেড রো বরাবর—হুকুম করে টমাস।
গাড়ি এসপ্লানেড রো ধরে চলে।
টমাস বলে, কাল রাতে আমরা এই পথ দিয়ে এসেছিলাম।
একটু পরে আবার টমাস আরম্ভ করে—এবারে আমরা ওন্ড কোর্ট হাউস স্ট্রীটে এসে পড়েছি। এই রাস্তাটা দক্ষিণদিক বরাবর খিদিরপুর, গার্ডেনরীচ, আলিপুর পর্যন্ত চলে গিয়েছে।
তার পর বিশেষভাবে মিসেস কেরীকে লক্ষ্য করে বলে, একদিন ওদিকে তোমাকে নিয়ে যাব। খুব সুন্দর আর রুচিসঙ্গত সব বাড়িঘর। এদিকটা দেখে তোমার যে অরুচি হয়েছে তার প্রতিকার আছে ঐদিকে।
এমন সময় কেরী বলল, ডরোথি, ঐ প্রকাণ্ড জানোয়ারটা কি বলতে পার?
ডরোথি বলল, কেমন করে জানব, আগে কখনও দেখি নি!
ওটা উট।
উট!
ডরোথি অবাক!
ওর পিছনে ওটা কি?
এবারে টমাস বলল, গাড়ি। এ দেশে উটের গাড়ি চলে। অনেক জায়গায় ও ছাড়া অন্য যানবাহন নেই।
ডরোথির বিস্ময় আরও বাড়ে। তার মনে উটের সঙ্গে সাহারার অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক দাঁড়িয়ে গিয়েছে! এহেন স্থানে সেই উট! পিছনে আবার একটা মস্ত উঁচু গাড়ি জোতা। বিস্ময়ে সে যখন হতবুদ্ধি ও নিস্তব্ধ এমন সময় হঠাৎ চমকে উঠল—
ওগুলো কি? ওগুলো কি পাখী?
গোটাকয়েক হাড়গিলে কোথা থেকে উড়ে এসে মোড়ের মাথায় বড় বাড়িটার আলসের উপর বসল।