পাছে এলিজাবেথ একটা অদ্ভুত কিছু বলে বসে তাই জন তাড়াতাড়ি বলে উঠল না, এমন কিছু নয়। ও কেন যাবে না তাই জিজ্ঞাসা করছিলাম।
এলিজাবেথ বলল, জন, তুমি যখন বলছ যাচ্ছি, কিন্তু ‘ফ্লাই ইন দি অয়েন্টমেন্ট’ না হয়ে থাকি।
সে দেখা যাবে, এখন চল তো।
গাড়ি দুখানা ফটক থেকে বেরিয়ে বেরিয়াল গ্রাউন্ড রোড ধরে চৌরঙ্গীর দিকে চলল। যে শহরে জীবনের শ্রেষ্ঠ একচল্লিশ বৎসর কাটবে সেই কলকাতা তার বৈচিত্র্য ও অভিনবত্ব নিয়ে কেরীর চোখে হেমন্তপ্রভাতের স্নিগ্ধ আলোয় এই প্রথম উদ্ভাসিত হল।
বেরিয়াল গ্রাউণ্ড রোডের দুদিকে প্রকাণ্ড হাতাওয়ালা বড় বড় সব বাড়ি, অধিকাংশ বাড়িই একতলা, তবে বাড়ির সংখ্যা বেশি নয়, বড়জোর দশ-বারোটা হবে।
চৌরঙ্গী রোডে গাড়ি পৌঁছতেই মিসেস কেরী সবিস্ময়ে জিজ্ঞাসা করল—ও কি, ঐ লোকটা অমন করে রাস্তার উপর গড়াচ্ছে কেন?
সকলে দেখল সত্যই একটা লোক একবার রাস্তার উপর সটান উপুড় হয়ে শুয়ে পড়ছে আবার উঠে দাঁড়িয়ে কি যেন বিড় বিড় করে বলছে, তার পর আবার আগের মতই উপুড় হয়ে শুয়ে পড়ে সুমুখে হাত বাড়িয়ে পথের উপর দাগ কাটছে।
কেরী-পত্নী বলল, লোকটা বোধ হয় পাগল, গায়ে তো বস্ত্র নেই দেখছি।
রামরাম বসু বলল, না মিসেস কেরী, লোকটা মোটেই পাগল নয়। ও চলেছে কালীঘাটের মন্দিরে। কোন কারণে এইভাবে কালীমন্দিরে যাওয়ার প্রতিজ্ঞা করেছিল, এখন সেই প্রতিশ্রুতি রক্ষা করছে।
ও কত দূর থেকে আসছে?
ওর গ্রাম থেকে, হয়তো বিশ-ত্রিশ মাইল হবে, হয়তো আরও বেশি হবে।
এ যদি পাগলামি না হয়, তবে পাগলামি আর কি?
পার্বতী বলল, আমরা ওর আচরণকে ধর্ম বলে মনে করি।
মিসেস কেরী অপ্রসন্ন মুখে বলল, ঘোর কুসংস্কার!
পাদ্রী টমাস বলল, এবারে ডাঃ কেরী এসে পৌঁছেছে, এখন ওসব দূর হয়ে যাবে।
কেরী প্রসঙ্গ ঘুরিয়ে দেবার উদ্দেশ্যে শুধাল, ঐ দিঘিটার নাম কি?
বেরিয়াল গ্রাউন্ড রোড ও চৌরঙ্গী রোডের মোড়ে একটা বড় দিঘি সবাই দেখল।
টমাস বলল, ওটার এখনও কোন নামকরণ হয় নি, সবে দু বছর তৈরি হয়েছে, সবাই এখনও নিউ ট্যাঙ্ক বা নঈ তলাও বলে। কি বল বসু?
রাম বসু বলল, হাঁ, ঐ নামেই চলছে। আর ঐ যে ছোট রাস্তাটা ডান হাতে বেরিয়ে গিয়েছে ওটার নাম ঝাঝরিতলাও রোড।
কেরী বার-দুই উচ্চারণ করল, ‘তলাও’, ‘তলাও’! বলল, আচ্ছা তলাও মানে কি?
তলাও মানে ট্যাঙ্ক, বলল একসঙ্গে পার্বতীচরণ, রাম বসু ও টমাস।
ঐ রাস্তাটার উপরে ঝাঁঝরি বা ল্যাটিওয়ার্ক ঘেরা একটা তলাও আছে, তাই থেকে রাস্তাটার নাম হয়েছে ঝাঝরিতলাও বোড়।
কেরী বলল, রাস্তার পশ্চিমে আগাগোড়া জঙ্গল দেখছি।
রাম বসু বলল, ঐ জঙ্গলের মাঝে মাঝে আছে বড় বড় সব জলা, আর তার চারদিকে নলখাগড়ার বন।
টমাস বলল, এখন তো জঙ্গল প্রায় শেষ হয়ে এসেছে, দশ বছর আগে যা দেখেছি।
এর চেয়েও বেশি ছিল নাকি?
বেশি? ওয়ারেন হেস্টিংস ওখানে হাতী নিয়ে বাঘ শিকারে আসত।
‘বাঘ’ শব্দে মিসেস কেরী কান খাড়া করল।
কেরী দেখল, সমূহ বিপদ। সে বুঝেছিল বাঘ জটার চেয়ে বাঘ শব্দটা কম মারাত্মক হবে না মিসেস কেরীর কাছে। প্রসঙ্গান্তরে যাওয়ার আশায় শুধাল, এখানে নিশ্চয়ই নয়?
টমাস বলল, না, ঠিক এখানে নয়, আর একটু দক্ষিণে, বির্জিতলাও বলে সে জায়গাটাকে।
রাম বসু তো কেরীর রাত্রির অভিজ্ঞতা জানে না, পাছে বাঘের আশঙ্কায় ঘাটতি পড়ে দেশের গৌরব কমে, তাই বলল, অতদিনের কথায় কাজ কি, এই সেদিন আমরা দিনের বেলায় খিদিরপুরে নালার কাছে বাঘের মুখে পড়েছিলাম কেমন না, পার্বতী দাদা?
বাঘ বলে বাঘ! সারা অঙ্গে কালো কালো ডোরা কাটা। মনে পড়লে এখনও গা শিউরে ওঠে—এই বলে পার্বতী একবার নড়ে-চড়ে বসল।
কেরী ভাবল, যেখানে বাঘের ভয়, সেখানেই সন্ধ্যাগম ঘটে।
মিসেস কেরী স্বামীর দিকে তাকিয়ে ধিক্কারের সুরে বলল—ভাল দেশে এনেছ।
এমন সময় একটা হাতী দেখে কেরী ভাবল, যাক, হাতীতে আজ রক্ষা করল বাঘের হাত থেকে।
কেরী বলল, ঐ দেখ।
সকলে দেখতে পেল গজেন্দ্রগমনে প্রকাণ্ড এক হাতী চলেছে, কাঁধের উপরে তার মাহুত, আর পিছনে জন দুই-তিন বর্শাধারী পাইক।
কিন্তু কেরী আজ এত সহজে রক্ষা পাবে না।
মিসেস কেরী উদ্বিগ্নভাবে বলল, বাঘ শিকারে চলেছে বুঝি?
টমাস ব্যাপারটা অনুমান করতে পেরেছিল, তাই বলল, না না, এদিকে বাঘ কোথায়? আর দু-চারটে থাকলেও তারা মানুষ খায় না।
কেন, সবাই বাইবেল পড়েছে বুঝি?–পত্নীর এবম্বিধ অখ্রীষ্টানোচিত উক্তিতে মর্মাহত কেরী প্রমাদ গুনল।
রামরাম বসু মনে মনে বলল—বাঘগুলো এখনও বাইবেল পড়ে নি তাই রক্ষা!
রাস্তার দু পাশে বরাবব কাঁচা নালা, মাঝে মাঝে যেখানে বেশি জল জমেছিল সেখানে এখনও জল শুকোয় নি। জলে অনেকদিনের অনেকরকম আবর্জনা পচে দুর্গন্ধ উঠছে; যেখানে আবর্জনার স্তূপ বেশি সেখানে কুকুরে শালিখে কাকে টানাটানি শুরু করেছে। এমন সময়ে উৎকট পচা গন্ধে সকলে সচকিত হয়ে উঠল। কিন্তু অধিক সন্ধান করতে হল না—একটা মৃত অধভুক্ত নরদেহ আড়াআড়ি ভাবে রাস্তার উপরে শায়িত, গোটা চার-পাঁচ বীভৎস শকুনি মাংস ছিঁড়ছে। গাড়ির চাকার শব্দে তারা উড়ে নালার ওপারে। গিয়ে বসল। এতক্ষণ গোটা দুই কুকুর শকুনের পাখাশাপটের ভয়ে কাছে ঘেঁষতে পারছিল না, সুযোগ বুঝে এবারে তারা মৃতদেহের উপরে গিয়ে পড়ল। ওদিকে স্বত্ব যায় দেখে শকুনিগুলো পাখা ঝাপটে কর্কশ ধ্বনি শুরু করে দিল।